ড. মারুফ মল্লিক »

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়িদের একখানা ভিডিও লইয়া বেশ আলোচনা হচ্ছে। পক্ষে, বিপক্ষে; দুই দিকেই কথা হইতেছে। আমিও দেখলাম ভিডিওখানা। অধ্যাপক সাহেবের রসময় কথায় লোকজন হেসে গড়িয়ে পড়ছিল। আসলেই তো ওরা শ্রমিক, শিক্ষা নেই। বিমানে বসে ফরম পুরন করতে পারে না। বিমানে চাকা ঢাকায় ষ্পর্শ করলেই জানালা দিয়ে উকি দিয়ে দেশের মাটিকে দেখার চেষ্টা করে। এরা নাগরিক শিক্ষিত না। দাঁত লুকিয়ে হাসতে পারেন না। শব্দ করে হাসেন। উচ্চস্বরে কথা বলেন। একবারে মাটির ভাষায়। প্রমিত বাংলায় এলেম, গেলেম, খেলেম বলতে এরা জানে না। ৪৭ এর আগে বাঙাল, চাষা বলে এদের সঙ্গে ঠাট্টা মশকরা হতো। এখন শ্রমিক, কামলা বলা হয়। এদের নিয়ে ঠাট্টা তামাশা তো একটু করাই যায়। তাও যদি আবার আলোর কারবারি সাহেব করেন তবে তো কথাই নেই।

এসব আলোচনায় না যাই। একটা গল্প বলি। ২০০৮ সাল। প্রথম ইউরোপ ভ্রমনের সুযোগ আসলো। বার্লিনে দুই মাসের একটি প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত হইছিলাম। ইন্টারন্যাশনাল ইন্সস্টিটিউট অব জার্নালিজম এ পরিবেশ সাংবাদিকতা বিষয়ে প্রশিক্ষন। আমি রোমঞ্চিত। কিছুটা উত্তেজিতও। বার্লিনের নাম অনেক শুনেছি। পড়েছি। স্কুলে থাকার সময় এরিখ কাস্টনারের এমিলের গোয়েন্দা দল পড়ে বার্লিন মনের ভিতরে গেঁথে যায়। নানাবিধ চিন্তা, কিছুটা ভালো লাগা, কিছুটা ঘোরের মধ্যে ভিসাটিসার পর্ব শেষে নির্ধারিত দিনের শেষরাতে ঢাকা বিমানবন্দরে বোর্ডিং পাস এর জন্য দাড়াইলাম। ইউরোপ সফরের উত্তেজনায় আমি আচ্ছন্ন। আশপাশে দেখলাম একই রঙের টি শার্ট পড়া যুবা বয়সী অনেকেই। মনে হয় একই কোম্পানী থেকে বিদেশে যাচ্ছে কাজ করতে। বিশেষ একটা খেয়াল করি নাই। হঠাতই দেখলাম এক ছেলে কোলে একটি কাঠাঁল নিয়ে লাইনে ঠিক আমার পিছনেই দাড়ায়া আছে। কাঁঠালের গন্ধ নাকে আসছে। বয়স খুব বেশি না। ১৯ কি ২০। তার দিকে তাকাতেই এক কথা, দুই কথায় আলাপ জমে উঠলো। ব্রাহ্মনবাড়িয়া থেকে সৌদি যাচ্ছে দোহা হয়ে। এর আগে কখনই ঢাকা আসেন নাই। গাছ থেকে পেড়ে মা কাঁঠালটা দিছে। পরম মমতার চিহ্ন। বার বার সে জানতে চাইছিল তাকে যেতে দিবে কি না। বিমানবন্দরে নাকি ঝামেলা করে। বল্লাম, ভিসা, পাসপোর্ট সব ঠিক থাকলে না যেতে দেওয়ার কোনো কারণ নাই।

ইমিগ্রেশনে এবার আমাকে আটকে দিল। বলে আপনিতো সাংবাদিক। জিও কোথায়? তখন উদ্দিনস সরকারের আমল। সব বিষয়ে খুব কড়াকড়ি। দেশ থেকে সব অনিয়ম চিরতরে নির্মূল করে দিবে উদ্দিনসরা। খানিকটা চুপ করে থাকলাম। দেখি ইমিগ্রেসন অফিসার কি বলে? সে একই প্রশ্ন বার বার করছে। আপনার জিও কই। শেষে বল্লাম আমার জিও লাগবে না। আমি সরকারি চাকুরি করি না। আর আমার নামে বিদেশ ভ্রমনেও কোনো নিষেধাজ্ঞা নাই। প্রয়োজনে তালিকা দেখেন। আপনাদের এখানে এই তালিকা নিশ্চয়ই আছে। যাই হোক নিজেরা খানিকটা আলাপ আলোচনা শেষে সিল দিয়ে পাসপোর্ট ফিরত দিল।

এবার বিমানে উঠার লাইনে দাড়িয়ে দেখি সেই ছেলে কাঠাল নিয়েই দাড়ায় আছে। এটা দেখে আলোকিত অনেকেই উসখুস করছে। কাঠাল বিমানের ক্যাবিনে! কিয়েক্টাবস্থা! সেই ছেলের সঙ্গে আমার আলাপ চলছেই। কাঁঠাল ছাড়াও মুড়ি আছে বোডিং লাগেজে। মা বেধে দিয়েছে। বাছা যদি বিদেশে গিয়ে কয়েকদিন ভাত, ডালের জোগার করতে না পারে। তবে কাঠাল মুড়ি দিয়ে দিন গুজরান করতে পারবে। পেটের জ্বালা মিটাবে। নানান পিঠাও নাকি আছে লাগেজে। বাড়িতে মা বাবা, ভাই বোন আছে। বিদেশে যাওয়ার জন্য কিছু ধার দেনাও করতে হইছে। সৌদি গিয়ে কাজ করে সেটা শোধ করতে হবে। ভাই বোনের স্কুলের খরচ দিতে হবে। সৌদি আরবে গিয়ে কি কাজ করতে হবে তখনও জানে না সে। তবে দেশের আদম বেপারি বলছে মাঠে নাকি পশুর খামারে কাজ করতে হবে। আমি বল্লাম সৌদিতে অনেক গরম। দিনের বেলায় সেখানে খামারে কাজ করবেন কিভাবে? ঘর থেকে বের হইলেই নাকি খুব গরম লাগে। সে বলে না পারবো। সমস্যা হবে না। সে স্বপ্ন দেখছে একদিন তার পরিবার দাড়িয়ে যাবে। অভাব ঘুচবে। যখন তার বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর কথা। কলেজে থাকার কথা। সব কিছুকে পেছনে ফেলে সে পরিবারে বড় ছেলে হিসাবে সব কিছুর জোঁয়াল কাঁধে নিয়ে বিদেশে ছুটছে। শুধু পরিবার না দেশের মেরুদন্ডই শক্ত করে দিচ্ছে এই রকম লাখো শ্রমিক।

হয়ত অনেকদিন পর যখন সে দেশে ফিরবে তার মন উসখুস করতে থাকবে। বিমান মাটিতে নামার সঙ্গে সঙ্গেই সে বের হতে চাইবে। কোন দরোজা দিয়ে আগে বের হওয়া যায়। ফ্রক পড়া ছোট বোনটি কি বিমানবন্দরে আসছে। এখন সে সেই ফ্রক পড়া বোনটি কলেজে পড়ে। মায়ের আচলের গন্ধের জন্য আকুলতা বাড়বে। দেশে থাকার সময় মাঠ থেকে ফিরে আসলে মা আচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে দিতো। বিমানে ওঠার আগে একবার মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল। নেটওয়ার্ক খারাপ থাকায় ঠিক মত শুনতে পারেনি কে কে তাকে নিতে আসবে। ছোট ভাই ঢাকায় আসার জন্য গাড়ি ভাড়া করেছে। সে এখন ঢাকায় এক বেরসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তবে বিমানে নিশ্চয়ই কোনো আলোর ফেরিওয়ালা থাকবে। সে পরে কোনো নাগরিক সভায় তার এই আকুলতা নিয়ে গপ্প করবে। সামনে উপবিষ্ঠ আলোকিতরা সেই গপ্প শুনে একে অন্যের গায়ে গড়িয়ে পড়বে হাসতে হাসতে।

কাঁঠাল এখানে সিম্বল মাত্র। এখানে কৃষকের ছেলে প্রবাসে যাচ্ছে শ্রমিক হিসাবে। এদের শ্রমে ঘামের পয়সায় আলোকিতরা বিমানে চেপে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ান। সভা, সেমিনারে যান। আরো আলোকিত হওয়ার চেষ্টা করেন। ঠাট্টা, তামাশার সুযোগ পান। এই কাঁঠাল মুড়িতে মায়ের আবেগ, ভালোবাস টের পান না। গেয়ো মনে করেন। ঠাট্টার উপাদান খুজে পান। লাখো শ্রমিকের ঘামের গন্ধ আলোকিতদের নাকে যায় না। বিমানে তাদের হুড়োহুড়ি দেখতে পান। কিন্তু পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে তা টের পান না। এই শ্রমিকরা কোটি কোটি মানুষকে আলোর জোগান দিচ্ছে তা বুঝতে পারেন না। সেই ক্ষমতা তাদের নেই।

বাংলাদেশের আলোকিত এলিটরা ক্রমশই গনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন। রাজাধানীর গণমাধ্যমেই তাদের উপস্থিতি দেখা যায়। সারাদেশে কোনো অস্তিত্ব নেই। এদের জনগনের পাশে পাওয়া যায় না। আশার কথা হচ্ছে এদের চ্যালেঞ্জ করে নুরু রাশেদরা উঠে আসছে। স্কুলের বাচ্চারা রাজপথ কাঁপাচ্ছে। প্রাবাসী শ্রমিক, পোশাক শ্রমিকার দেশের অর্থনীতির ভিত গড়ে দিচ্ছে এরা যদি কখনও দলে ভারী হয়ে সারাদেশ দখল করে দেখা যাবে তথাকথিত আলোকিতরাই গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত। এতদিন আলোকিত হওয়ার মিথ্যে ভান ধরেছেন কেবল। সমাজ, দেশ, মাটিকে অনুধাবন করতে পারেননি। (লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া, অসম্পাদিত)

ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন, জার্মানি।

শেয়ার করুন »

মন্তব্য করুন »