: দেশের কর্তাব্যক্তিরা যাই বলুন, হংকং, শ্রীলঙ্কা, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম যেভাবে করোনা মোকাবেলা করেছে আমরা তা পারিনি। আর পারিনি বলেই ওয়ার্ল্ডোমিটার বলছে, করোনা সংক্রমণের সংখ্যার দিক থেকে শীর্ষ ২৫ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ২১ নম্বরে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ৩য়। কিন্তু নমুনা পরীক্ষার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্ন। ৪ জুন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৭৮১ জনের এবং ৫৭ হাজার ৫৬৩ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন।
তবে পরিসংখানের চেয়ে বাস্তব অবস্থা অনেক ভয়াবহ। হাজার হাজার মানুষ করোনা পরীক্ষার জন্য হন্য হয়ে ঘুরছেন, কিন্তু সিরিয়াল পাচ্ছেন না। আক্রান্তরা হাসপাতালে সিট পাচ্ছেন না। আইসিইউ-তে বেড খালি নেই। ভেন্টিলেটর নেই। অক্সিজেন সিলিন্ডার নেই। মোটের উপর এখন করোনা চিকিৎসা পুরোপুরিই ‘আল্লাহ-ভরসা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে প্রতিদিনই চেনা-জানা মানুষ করোনায় মৃত্যুবরণ করছেন। সবার মধ্যে ভয়, আতঙ্ক। কোথাও কোনো পরিকল্পনা নেই, বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনো চেষ্টা নেই। ভরসা এবং সান্ত্বনাও নেই!
সরকার করোনা মোকাবেলায় একের পর এক ভুল করেছে, ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকার যে ৫১টি বড় ভুল করেছে সেগুলো হলো: ১. সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতা, ২. দেরিতে সাড়া দেয়া, ৩. আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অস্বাভাবিক দেরি করে বন্ধ করা, ৪. বিদেশ থেকে আসা, ব্যক্তিদের মোবাইল নম্বর ও মোবাইল সেটকে যোগাযোগ, প্রচার, নজরদারির হাতিয়ার না বানানো, ৫. বিদেশ থেকে আগত মানুষদের কোয়ারেন্টাইনে রেখে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা না করা, বিদেশ থেকে যারা এসেছে তাদের সবাইকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট করে টেস্টের ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক না করা,
৬. মার্চের শুরু থেকে সকল বিমানবন্দর ও স্থল বন্দরে অত্যাধুনিক থার্মাল স্ক্যানার, যার মাধ্যমে যাত্রীদের স্ক্রিনিং করা হয়, অর্থাৎ কারো জ্বর থাকলে এই স্ক্যানারে সেটা ধরা পড়বে, তেমন যন্ত্র স্থাপন করতে না পারা, ৭. শনাক্তকরণ, বিচ্ছিন্নকরণ ও চিকিৎসা- এ মূল বিষয়গুলোর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিভাগের ব্যর্থতা সত্ত্বেও কোনো কার্যকর উদ্যোগ না নেয়া, ৮. ভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা ব্যবস্থা এবং চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা উপযোগী সরঞ্জাম আমদানি বা তৈরি এবং ব্যবস্থাপনা জরুরি ভিত্তিতে করতে না পারা, ৯. দ্রুত গতিতে বেশ কয়েকটা বিশেষায়িত হাসপাতাল স্থাপন করতে না পারা, ১০. হোম কোয়ারেন্টাইন কার্যকর করতে না পারা, ১১. শুরু থেকেই ঢাকার বাইরে পরীক্ষার ব্যবস্থা না করা,
১২. একটা কার্যকর টাস্কফোর্স গঠন না করা, ১৩. বিমানবন্দরের অদূরে কার্যকর ও মানসম্পন্ন কোয়ারেন্টাইন সেন্টার করতে না পারা, ১৪. আসল প্রস্তুতির চেয়ে লোক দেখানো আড়ম্বর করা, ‘সবকিছু প্রস্তুত’, ‘আমাদের প্রস্তুতিসম্পন্ন’ কিংবা ‘বাংলাদেশে করোনাভাইরাস আসবে না’ এসব অর্বাচীন কথার আড়ালে ভয়াবহ আত্মসন্তুষ্টি রোগ, সমস্যা অস্বীকার করা, এমনকি কেউ কোনো সমস্যা ধরিয়ে দিলে উল্টো বৈরী ভাব এবং সরকারের সব পর্যায়ে গুণকীর্তন, তোয়াজ, স্তুতির আধিপত্য কমাতে না পারা, ১৫. হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক ও নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত ও মানসম্পন্ন সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) সরবরাহ না করা,
১৬. প্রয়োজনীয় ডাক্তার নার্স টেকনিশিয়ানের যোগান নিশ্চিত না করা, জরুরি প্রশিক্ষণ দিয়ে টেকনিশিয়ান তৈরি উদ্যোগ না নেয়া, ১৭. শুরু থেকেই ডাক্তারসহ চিকিৎসাকর্মীদের জন্য কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করতে না পারা, তাদের বিভিন্ন হোটেলে রেখে কাজ করার যে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল, সেটা কার্যকর করতে না পারা, ১৮. বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে শুরু থেকে করোনা চিকিৎসায় অন্তর্ভুক্ত না করা, ১৯. করোনা চিকিৎসায় বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে ন্যূনতম ফি নির্ধারণ করে না দেয়া, ২০. করোনাবিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার সিভিল সার্জনদের না দিয়ে জেলা প্রশাসকদের দেয়া,
২১. শুরু থেকেই বিএমএ-সহ চিকিৎসক সংগঠনকে সম্পৃক্ত না করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমলাদের উপর নির্ভর করা, ২২. প্রশাসন, রাজনীতিবিদ, স্বাস্থ্য প্রশাসন ও নাগরিকদের নিয়ে এলাকাভিত্তিক কমিটি গঠন না করা, ২৩. করোনাভাইরাসআইসিইউ বা সিসিইউ চালানোর জন্য যে সব যন্ত্রপাতি লাগে সেগুলো সরবরাহ এবং তা চালানোর মতো দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে না পারা (অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, অনেক হাসপাতালে যন্ত্রপাতি কেনার কয়েক বছর পরেও তার ন্যূন্যতম ব্যবহার হয়নি, অনেক যন্ত্রের প্যাকেট খোলা হয়নি। এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, হাসপাতালের ওয়ারিং আছে টু পিন সকেটের আর যন্ত্রের কানেকশন লাগে থ্রি পিন সকেটে। একটা সকেট চেঞ্জ না হওয়াতে ঐ যন্ত্রের ব্যবহার হয়নি অনেক বছর। ইতিমধ্যে যন্ত্রের আয়ু শেষ হয়ে গেছে।
কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের নামে লোপাট হয়েছে কোটি কোটি টাকা!), ২৪. সংক্রমণের শুরু থেকেই ধর্মীয় সমাবেশের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করা, ২৫. কমিউনিটির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে না পারা, ২৬. মাস্ক, পিপিই কিটের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা চিকিৎসকদের বদলি করা, ২৭. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে দরিদ্র মানুষের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে না পারা, ২৮. সর্বদলীয় মহামারী মোকাবেলা কমিটি গঠন না করা, ২৯. করোনা মোকাবেলায় স্থানীয় সরকারকে কাজে না লাগানো, ৩০. গরিব মানুষের হাতে নগদ টাকা দিতে কার্যকর কোনো ম্যাকানিজম তৈরি করতে না পারা,
৩১. মানুষকে ঘরে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে, কিন্তু মানুষ খাবে কী, পাবে কোথায়-এসব বিষয়ে আগেভাগেই সিদ্ধান্ত না নেয়া, ৩২. কোয়ারেন্টাইন কী-সেটা মানুষকে ভালোভাবে বোঝাতে না পারা। কোয়ারেন্টাইন মানে কাউকে বদ্ধ ঘরে তালা মেরে রাখা নয়, বরং বাইরে বের হয়ে অন্য মানুষকে সংক্রমিত করা বা অন্য কারো মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়া থেকে মুক্ত থাকা-এটা মানুষকে ভালো করে বোঝাতে না পারা, ৩৩. রোগ পরীক্ষার মাপকাঠি শিথিল করে বেসরকারি পরীক্ষা কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াতে অনেক সময় নেওয়া। এ ব্যাপারে সক্ষমতা ও দক্ষতা না বাড়ানো, ৩৪. দীর্ঘায়িত ছুটির কারণে অর্থনৈতিক ভাবে সবচেয়ে আক্রান্ত অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের জন্য একটি কার্যকর অর্থনৈতিক প্যাকেজ তৈরি করতে না পারা,
৩৫. যদিও করোনাভাইরাস প্রতিরোধে একটি কেনিক্যাল উপদেষ্টা কমিটি, একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে, কিন্তু দুই কমিটির কোনো কর্মতৎপরতার খবর পাওয়া যায়নি। কমিটিগুলোকে সক্রিয় করতে না পারা, করোনা-উত্তর পরিস্থিতির মোকাবেলা করার জন্য একটি ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে উদ্যোগহীনতা, ৩৬. চিকিৎসা ও খাদ্য যোগান উভয় ক্ষেত্রেই প্রস্তুতিহীনতা বা উদ্যোগহীনতা, ৩৭. একদিকে করোনা পরীক্ষার সামগ্রী সংগ্রহ, বুথ স্থাপন, দায়িত্ব বন্টন, হাসপাতাল নির্দিষ্ট করা আইসিইউ-ভেন্টিলেটর প্রস্তুত রাখা, ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষাসামগ্রী প্রস্তুত রাখার ক্ষেত্রে পাহাড়সমান ব্যর্থতা দূর করতে না পারা, ৩৮. সঠিক তথ্য দিতে না পারা। মিথ্যা প্রচার ঠেকানো এবং বিজ্ঞানসম্মত তথ্য প্রদানে ব্যর্থতা,
৩৯. চিকিৎসকদের জন্য সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহের ক্ষেত্রে যে সব প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে, নিম্ন মানের জিনিস গছিয়ে দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন না নেয়া, ৪০. চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য কর্মীদের আগাম প্রশিক্ষণ না দেয়া, ৪২. কারখানা খোলা-বন্ধের যথেচ্ছাচারে গার্মেন্টস মালিকদের প্রতি কঠোর হতে না পারা, সাধারণ ছুটির মধ্যেও মালিকদের কূট-চালে সারাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে আসা যাওয়া আটকাতে না পারা, ৪৩. সমাজের বিভিন্ন সংগঠন ও গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা-মতবিনিময়-পরামর্শ করে সমন্বিত সাংগঠনিক কাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে উদ্যোগহীনতা,
৪৪. সরকারি এককালীন ত্রাণের ঘোষণা, ‘উপহার’ প্রদানের কর্মসূচি প্রয়োজনের তুলনায় বাড়াতে না পারা, সঠিক ব্যক্তির কাছে সেগুলো না পৌঁছানো, ৪৫. ঢাকা নারায়ণগঞ্জ থেকে যেসব শ্রমিক গ্রামে ফিরেছে তাদের উপযুক্ত পরীক্ষা ও সরকারি কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা না করা, ৪৬. প্রথম থেকেই সাধারণ মানুষকে রেশনের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে না দেয়া এবং ত্রাণ-রেশন নিয়ে চূড়ান্ত দুর্নীতি ঠেকাতে না পারা, ৪৭. রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা/টেস্ট বাড়াতে না পারা,
৪৮. সংক্রমণ কমাতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে পারা। যাদেরকে শনাক্ত করা হয়েছে তাদের কন্টাক্ট ট্রেসিংও ঠিকভাবে হয়নি, তারা কাদের সাথে মিশেছেন, কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন, এইসব বিশ্লেষণ করা জরুরি ছিল। সংক্রমিতদের সীমাবদ্ধ করে রাখার কাজটিও ঠিকভাবে করা হয়নি। এখনো এক্ষেত্রে একটা সমন্বয়হীনতা রয়েছে। এখন যে রোগী শনাক্ত হচ্ছে, তারা কোথায় যাবে, কীভাবে যাবে, তা নিয়ে সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে, ৪৯. সাধারণ ছুটি বাড়ানো, শিথিল করা বা শর্তসাপেক্ষে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান চালু করা- কোনও ক্ষেত্রেই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, ভাইরোলজিস্ট, এপিডেমিয়োলজিস্টদের নিয়ে গঠিত কোনও কমিটির মতামত না নেয়া, ৫০. ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাবার সুযোগ করে দেয়া, ৫১. ঈদের পর সব কিছু চালু করে সরকার করোনা নিয়ন্ত্রণের সব দায়িত্ব থেকেই হাত গুটিয়ে নিয়ে এবং সব দায় মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়ে দেশকে ঘোর বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া।
হ্যাঁ, নতুন ভাইরাস এবং এমন নজিরবিহীন বৈশ্বিক মহামারির বিরুদ্ধে প্রস্ততি ও উদ্যোগে ভুল হতেই পারে। ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা জরুরি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকারের কি আদৌ সেই ইচ্ছে আছে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব।চ্যানেল আই