দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি ভুগছে নানামুখী সমস্যায়। বিভিন্ন ধরনের সমীকরণ মেলাতে গিয়ে অযাচিত সিদ্ধান্ত নিয়ে একসময়ের বেশ জনপ্রিয় দলটি এখন হতাশার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এর মধ্যে এবার ছড়িয়েছে বিএনপির মহাসচিব পদ নিয়ে গুঞ্জন। কেউ কেউ বলছেন, খুব দ্রুতই মহাসচিব পদ থেকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ পদে আনা হচ্ছে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের একেবারে অনুগত কাউকে। আবার অনেকে এমন গুঞ্জনকে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহাসচিব পদে পরিবর্তনের এ গুঞ্জনের ডালপালা তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। নতুন মহাসচিব হিসেবে কে আসতে পারেন, এ প্রশ্নে কয়েকটি নামও আলোচিত হচ্ছে নেতাকর্মীদের মধ্যে। মির্জা ফখরুলও তার শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন পদে থাকা, না থাকার বিষয়ে। তাকে মহাসচিব পদ থেকে সরিয়ে দিতে চাইলে তিনি আগেভাগেই পদত্যাগ করবেন কি-না, সে বিষয়েও চলছে আলোচনা।
২০১১ সালের ১৬ মার্চ তৎকালীন মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মৃত্যুর কয়েকদিন পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সৌদি আরব সফরে যাওয়ার প্রাক্কালে মির্জা ফখরুলকে দলের মহাসচিবের কাজ চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেন। সেসময় দলের সিনিয়র নেতাদের একাংশের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। অনেকে প্রকাশ্যেই ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব পদে ফখরুলের বিরোধিতা শুরু করেন। দলের গঠনতন্ত্রে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলতে কোনো পদ না থাকলেও ফখরুল প্রায় পাঁচ বছর সেই ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হয়েই দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। সেসময়ও তাকে যেন মহাসচিব করা না হয় সেজন্য ব্যাপক বিরোধিতা চলে দলের মধ্যে। এমনকি তারেক রহমান নিজেও ফখরুলকে মহাসচিব পদে চাইছিলেন না বলে খবর ছড়ায়। কাউন্সিল হওয়ার ১১ দিন পর ৩০ মার্চ খালেদা জিয়ার একক সিদ্ধান্তে ‘ভারমুক্ত’ হয়ে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিবের পদে আসেন মির্জা ফখরুল।
সেসময় বলা হয়, ফখরুলকে মহাসচিব পদে বসানোর পেছনে বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীরা খালেদা জিয়াকে সম্মত করিয়েছিলেন। তবে ফখরুলের মতো একজন ভদ্র-মার্জিত নেতাকে মহাসচিব করায় খালেদা জিয়া বিরোধীপক্ষের কাছ থেকেও ধন্যবাদ পেয়েছিলেন। সেই ফখরুল এখনও হাল ধরে আছেন দলের।
এর মধ্যে ২০১৮ সালে খালেদা জিয়া কারাগারে যান। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান আগে থেকেই লন্ডনে নির্বাসনে। এমন অবস্থায় ফখরুলকে ঘিরেই আবর্তিত হতে থাকে বিএনপির নির্দেশনা-কর্মসূচি।
মির্জা ফখরুলের সমালোচকরা মনে করেন, বিএনপির আজকের পরিণতির জন্য মির্জা ফখরুলের ‘অতি নমনীয় ও অতি ভদ্রজনোচিত’ ভাবভঙ্গিই দায়ী। খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা, আশার বাণী শুনিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা, ফলাফলে ভরাডুবি, কারচুপির অভিযোগ তুলে ফলাফল প্রত্যাখ্যান, পরে এতে নির্বাচিত কয়েকজনের শপথ না নেয়ার ঘোষণা দেয়ার পরও শপথ নিয়ে সংসদে যাওয়া, পরবর্তী সময়ে কয়েকটি আসনে উপ-নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাবন্দি থাকাবস্থায় তার মুক্তির দাবিতে কোনো জোরদার আন্দোলন করতে না পারার পেছনে মহাসচিব হিসেবে ফখরুলের দায়ই বেশি। কোনো যুৎসই সিদ্ধান্ত নিতে না পারা বা কোনো সিদ্ধান্তে অটল থাকতে না পারার ব্যর্থতা নেতৃত্বভাগে থাকা ফখরুলের কাঁধেই বর্তায়।
এর মধ্যে গত মার্চে সরকারের অনুকম্পায় দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারামুক্ত হলেও রয়েছেন রাজনীতির অন্তরালে। অসুস্থতা, করোনা পরিস্থিতি ও সরকারের শর্ত— সবমিলিয়ে খালেদা জিয়ার অল্প সময়ের মধ্যে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন না। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান ভার্চুয়াল পন্থায় লন্ডন থেকে দলের ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন।
একটি সূত্র জানায়, ইদানীং দলের বিভিন্ন কমিটি গঠন, অনুমোদন, কার্যক্রম স্থগিত— এমন কোনো কিছুর বিষয়ে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অবগত নন। এসব বিষয় মূলত লন্ডন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের নির্দেশে সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদই সেরে ফেলছেন।
আরেক সূত্রের মতে, অনেক কার্যক্রম রিজভী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনকে ‘বুঝিয়ে’ করে ফেলেন। যার কোনো কিছুই মহাসচিবকে অবহিত করার প্রয়োজন বলে মনে করেন না তিনি। এতে শীর্ষ নেতারাও অনেকটা বিব্রত। মির্জা ফখরুল নিজেও এসব বিষয় নিয়ে কিছুটা বিব্রত ও ক্ষুব্ধ।
এমন অবস্থায় বলা হচ্ছে, বিএনপিতে নতুন মহাসচিব আসছেন। যেহেতু ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান, সেহেতু তার অনুসারী কেউ একজন এ দায়িত্ব পাবেন বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতাকর্মী থেকে সিনিয়র নেতারাও। অনেকেই মনে করেন, ফখরুল বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়ার অনুগত হলেও তারেক রহমানের প্রতি তার আনুগত্য নিয়ে নানা সময়ে আলোচনা হয়েছে। আবার নেতাকর্মীদের একটি অংশ মনে করেন, অবশ্যই ফখরুল ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের আনুগত্য মানেন। না হলে এতদিন মহাসচিব পদে থাকতে পারেন না। তবে যেহেতু এ পদে তিনি প্রায় ১০ বছর দায়িত্ব পালন করছেন, সেহেতু অন্য কেউ এ পদে এলে সেটা বিচিত্র কিছু হবে না।
তবে সিনিয়র নেতাদের অনেকে মহাসচিব পদে পরিবর্তনের গুঞ্জনকে ‘অপপ্রচার’ হিসেবেই দেখছেন। তারা বলছেন, দলের মধ্যে বিভাজন ও বিভক্তি সৃষ্টির জন্যই একটি মহল এমন অপপ্রচার চালাচ্ছে।
মহাসচিব পদে এবার আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন তিন নেতা। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যার নাম উচ্চারিত হচ্ছে, তিনি হলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। আবার অনেক সিনিয়রকে ডিঙিয়ে স্থায়ী কমিটিতে ঠাঁই পাওয়া ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর নামও আলোচিত হচ্ছে। তিনি তারেক রহমানের বেশ অনুগত বলে প্রচার আছে। সিরাজগঞ্জের রাজনীতিতে প্রভাবশালী এ নেতা বর্তমানে দলের দুটি কমিটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। করোনা পরিস্থিতিতে দলের জাতীয় করোনা পর্যবেক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক এবং পরবর্তী সময়ে বন্যা পরিস্থিতিতে দলের গঠিত ত্রাণ কমিটিরও আহ্বায়ক করা হয়েছে তাকে।
অপরদিকে গুঞ্জন আছে, মহাসচিব পদটি পাওয়ার জন্য স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছেন দলের ‘ফুলটাইম’ রাজনীতিবিদ বলে পরিচিত রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। ১/১১-এর সময় থেকে লাইমলাইটে আসা সাবেক এই ছাত্রদল নেতা কখনোই থেমে থাকেননি। চলছেন তো চলছেনই। মামলা, গ্রেফতার কিংবা করোনা, কোনো কিছুই দমিয়ে রাখতে পারেনি তাকে। যদিও তার এসব বিষয় নিয়ে দলের মধ্যে রয়েছে নানা রকমের রাসাত্মক আলোচনা।
বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীরাও তার ওপর বিরক্ত। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বহুবারই রিজভীকে নিয়ে প্রকাশ্যে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির দফতর সম্পাদকের পদটি খালি থাকায় সেটিও সামলাচ্ছেন রুহুল কবির রিজভী। যদিও সমালোচকরা বলেন, রিজভী দফতর সম্পাদকের দায়িত্বে কাউকে আসতে দেননি ইচ্ছা করেই। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তার প্রভাব বলয় সৃষ্টি করতেই তিনি এসব করেছেন। সেদিক থেকে তাকে যদি তারেক রহমান মহাসচিব হিসেবে ঘোষণা দেন তাতে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপির সাতজন নেতা মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা হলেন- প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী (১৯৭৮-৮৬), লে. কর্নেল (অব.) মোস্তাফিজুর রহমান (১৯৮৬-১৯৮৭), কে এম ওবায়দুর রহমান (১৯৮৭-১৯৮৮), ব্যারিস্টার আব্দুস সালাম তালুকদার (১৯৮৮-১৯৯৬), আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া (১৯৯৬-২০০৭), খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন (২০০৭-২০১১) এবং বর্তমান মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (২০১১- ২৯ মার্চ ২০১৬ পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত এবং ৩০ মার্চ ২০১৬ থেকে পূর্ণাঙ্গভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত)।
দলের মহাসচিব পদে পরিবর্তনের আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘এ ধরনের কোনো আলোচনা নেই। যারা এ ধরনের কথা বলছেন, তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ কথা বলছেন।’
এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘২০০৯ সালের পর থেকে বিশেষ করে ২০১২ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে নেয়ার পর থেকে সংবিধান পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগ যে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করতে চাচ্ছে, তারই ফলশ্রুতিতে আমরা দেখছি, এখানকার সমস্ত রাজনৈতিক দলকে পুরোপুরিভাবে ইনঅ্যাক্টিভ (অকার্যকর) করে দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের বিরাজনীতিকরণের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় কিন্তু আজ দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় সাজা দেয়া হয়েছে। আমাদের দলের প্রায় ৩৫ লাখ লোকের বিরুদ্ধে লক্ষাধিক মামলা, পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীকে গুম, সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে খুন করা হয়েছে। সত্য কথা বলতে কী, শুধু আমরা নই, অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো এমনকি মিডিয়া, কেউই এখানে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমার কাজ সফল হচ্ছে, কি হচ্ছে না, এটা বিচার করার দায়িত্ব তো আমার নয়। এটা জনগণ বিচার করবে এবং পার্টি সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু দল তো এখন পর্যন্ত সে ধরনের কথা বলেনি। দল সে ধরনের সিদ্ধান্ত যদি নেয়, তা কার্যকর হবে।’
গত প্রায় এক দশক ধরে মহাসচিবের দায়িত্বে আছেন, বিএনপির রাজনীতি নিয়ে আপনি কতটুকু সন্তুষ্ট, বিএনপি আসলে ঠিক পথে আছে কি-না? জবাবে ফখরুল বলেন, ‘বিএনপি একটি উদারপন্থী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। বর্তমানে দেশে যে অবস্থা বিরাজ করছে, এখানে গণতন্ত্রের কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। সেক্ষেত্রে এখানে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের স্বাভাবিকভাবে কাজ করার পরিবেশ নেই এবং স্বাভাবিকভাবে আমরা এখানে যারা দায়িত্বে রয়েছি, কাজ করছি; আমাদের পক্ষে কাজ করা খুবই ডিফিকাল্ট (কষ্টকর) হয়ে যাচ্ছে।’