মো. মাহমুদুল হাসান »

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়ছে। উপকূলীয় বিস্তীর্ণ এলাকায় আবাদি জমির পরিমাণ দিনকে দিন কমছে। কমছে খাদ্য উৎপাদনের হারও। সেই সঙ্গে মাছসহ পশু-পাখি হাঁস-মুরগির উৎপাদনও ব্যাহত হওয়ায় আমিষের অপ্রতুলতায় ভুগছে মানুষজন।

জলবায়ু পরিবর্তন বনাম খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশ এমনিতেই পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। দেশে শতকরা ১ দশমিক ৪১ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিপরীতে ১ শতাংশ হারে আবাদি জমি কমছে। এর ফলে খাদ্যসংকট বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কৃষির জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঝুঁকিতে বাংলাদেশের অবস্থান

বিশ্ব জলবায়ু সংক্রান্ত ঝুঁকি ২০০৬-এর মূল্যায়নে ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা সম্পূর্ণ প্রতিহত করতে না পারলেও বিভিন্ন প্রযুক্তি ও কৌশল অবলম্বন করে পরিবর্তিত জলবায়ুতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।

আইপিসি’র রিপোর্ট

ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসি) এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গড় বার্ষিক তাপমাত্রা গত ১৪ বছরে মে মাসে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং নভেম্বর মাসে শূন্য দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া মাটির লবণাক্ততা ৮ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে বৃদ্ধি পেয়েছে।

সেই সঙ্গে গড় বৃষ্টিপাতও বৃদ্ধি পেয়েছে। পরপর বন্যা হয়েছে ২০০২, ২০০৩, ২০০৪ এবং ২০০৭ সালে। বেড়েছে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যাও। গ্রীষ্মকালে সমুদ্রের লোনা পানি দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ১০০ কিমি পর্যন্ত নদীতে ঢুকছে। এসব কারণে ফসলের উৎপাদন কমছে, কমছে মৎস্য উৎপাদনও।

কৃষিবিজ্ঞানীরা যা বলছেন

কৃষিবিজ্ঞানীরা বলছেন, বীজের অঙ্কুরোদ্গম, গাছের দৈহিক বৃদ্ধি, পরাগায়ণ, ফুল ধরা, ফল ধরা ও ফসল পরিপক্ব হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায় সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে সুনির্দিষ্ট তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত ও সূর্যালোক প্রয়োজন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এর হেরফের হওয়ায় ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আমাদের দেশে বিভিন্ন ঋতুতে যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন হচ্ছে তা মোকাবেলা করা। কারণ, দেখা যাচ্ছে শীতকালে বৃষ্টি হচ্ছে। আবার বর্ষাকালে বৃষ্টি না হয়ে গরমের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। আর এর সবচেয়ে বেশী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে উপকূলীয় ও চর এলাকায়। এসব কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন

বিশ্বব্যাংকের ২০০১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে বরফ গলে যাওয়ায় বঙ্গোপসাগরের উচ্চতা বছরে ৩ মিলিমিটার হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের ১ মিটার উচ্চতা বৃদ্ধিতে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল অংশ পানির নিচে তলিয়ে যাবে যা বাংলাদেশের মোট আয়তনের ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ। এতে ২২ হাজার ৮৮৯ বর্গকিলোমিটার কৃষিজমি তলিয়ে যাবে। ধানের উৎপাদন কমবে প্রায় ৩০ শতাংশ।

এভাবে কৃষিজমি তলিয়ে গেলে, ধানের উৎপাদন কমলে খাদ্য নিরাপত্তা ভয়ঙ্কর ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। খাদ্য নিরাত্তার ঝুঁকি কমাতে জলবায়ু সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবনের তাগিদ দিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা

জানা গেছে, বাংলাদেশে ১৯৯৮-’৯৯ সালে গমের আবাদি জমির পরিমাণ ছিলো ৮ দশমিক ৮২ লাখ হেক্টর। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গমের আবাদের পরিমাণ মাত্র ৭-৮ বছরের ব্যবধানে কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৭ লাখ হেক্টরে। একই অবস্থা অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও। ছোলা, মসুর, মুগসহ বিভিন্ন ডালে পরাগায়ণের সময় তাপমাত্রা, আর্র্দ্রতা ও কুয়াশার তারতম্য হচ্ছে বলে ফলন কম হচ্ছে।

এ জন্য এসব ফসল চাষ করা ছেড়ে দিচ্ছেন কৃষকরা। বোরো ধানের ফুল আসা পর্যায়ে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকলে ধানে চিটা হয়। দানা গঠনের সময় আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে ফলন কম হয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাস্তবে তাই ঘটছে।

কৃষিবিদের বক্তব্য

এ প্রসঙ্গে কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফসল উৎপাদন এমনকি মাছের প্রজননের ওপরও ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাছের প্রজননের সময় বৃষ্টিপাত না হওয়ায় মাছের ডিম মাছের পেটে শুকিয়ে প্রজনন ব্যাহত হয়েছে।

ফলে অনেক মাছের জার্ম বিলুপ্ত হয়েছে। পানির তাপমাত্রা ২৯-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে প্রজনন করতে পারে না। হালদা নদীতে তাপমাত্রা ২৬-৩০ ডিগ্রি হলে রুই ডিম ছাড়ে। তাপমাত্রা বাড়ায় ডিমের বাড়ায় ডিমের উৎপাদন ৩ হাজার কেজি থেকে কমে মাত্র ২০ কেজিতে দাঁড়িয়েছে।

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইন্সটিটিউটের রিপোর্ট

অন্যদিকে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইন্সটিটিউটের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় ১৯৭৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ১৭ লাখ হেক্টর জমি নতুন করে লবণাক্ত হয়েছে। লবণাক্ত হওয়ার এ পরিমাণ মোট জমির শতকরা ২০ দশমিক ৪ ভাগ।

তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে প্রতি বছর ৩০-৪০ লাখ হেক্টর জমি খরায় আক্রান্ত হয়। আর খরার কারণে ফসল, পশু, হাঁস-মুরগি ও মাছের উৎপাদন ব্যাহত হয়ে চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে খাদ্য নিরাপত্তা।

পরিশেষ

উপসংহারে বলতে চাই, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন এবং খাদ্য সুরক্ষার বিষয়টি বেশ উদ্বেগজনক। কারণ বহুল জনসংখ্যার একটি দেশ বাংলাদেশ। তাই উদ্বেগও বেশি। একদিকে জলবায়ুর পরিবর্তন অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান সমুদ্রের স্তর পরিবর্তনের সাথে সাথে বাংলাদেশের কৃষিখাত প্রচুর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।

খাদ্য সংকট এড়াতে টেকসই কৃষি বাস্তবায়ন জরুর। পরিবর্তিত জলবায়ুর মুখে খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সরকার, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য।

শেয়ার করুন »

মন্তব্যসমূহ »

  1. Pingback: কৃষির ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব » Leading News Portal : BartaBangla.com

মন্তব্য করুন »