বার্তাবাংলা ডেস্ক »

সেদিন অফিস শেষে বাসায় ফেরার পথে দোকানে দাঁড়িয়ে ফ্রোজেন পরোটা কিনছিলাম। দৈনন্দিন ব্যস্ততায় অনেক সময় খাবার তৈরি করে খাওয়ার সময়টুকুও মেলে না। তখন এমন ফ্রোজেন খাবারই ভরসা। চাকরি এবং সংসার একসঙ্গে সামলাতে পারে যে নারী, নিঃসন্দেহে তার সম্মান যেকোনো যোদ্ধার সমান। যাক সে কথা, আমার পাশেই দাঁড়িয়ে অন্যকোনো প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনছিলেন আমার মতোই অফিস ফেরত একজন পুরুষ। তিনি একবার আমার দিকে আরেকবার আমার হাতের ফ্রোজেন পরেটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘পরোটাও কিনে নিতে হয়? বাসায় গিয়ে তো আপনি নিজেই তৈরি করে নিতে পারেন!’

একই গ্রুপে কাজ করার সুবাদে তিনি আমাকে চিনে থাকবেন বা অন্তত এটুকু বুঝতে পেরেছিলেন যে আমি একজন কর্মজীবী নারী। তাকে বললাম, বাহ, আপনি তো ভীষণ কাজের লোক! অফিস থেকে বাসায় ফিরে পরোটাও তৈরি করেন! তখন তিনি বললেন, ‘আমি কেন তৈরি করবো! আমার স্ত্রী কিংবা মা তৈরি করেন। সারাদিন অফিস করে আবার গিয়ে পরোটাও তৈরি করবো নাকি!’ উত্তরে বললাম, আপনিও ফুলটাইম অফিস করে বাসায় ফিরছেন, আমিও ফুলটাইম অফিস করে বাসায় ফিরছি। আপনি যদি অফিসের কাজে ক্লান্ত হয়ে বাসার অন্যান্য কাজ না করতে পারেন, তাহলে আপনার কেন মনে হলো, অফিস করে আমি একটুও ক্লান্ত নই? আমার কাছে কী এমন মহাশক্তি আছে যা দিয়ে যে কাজগুলো আপনি পারেন না, তাই আমি করে ফেলবো! লোকটি আমার কথার জবাব দিতে না পেরে চুপচাপ নিজের পথে হাঁটা ধরলেন।

আশেপাশের অনেক পুরুষকেই বলতে শুনি, মেয়েদের আবার কাজ কী! থাকে তো সারাদিন বাসায়ই! ফেসবুকে মেয়েদের গ্রুপগুলোতে ঢুকলে আরও সব ভয়াবহ সংবাদ মেলে। সেখানে অনেকেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেন। কিভাবে, কতটা কষ্ট করে তারা দৈনন্দিন কাজগুলো সামলান তা জানান। যাদের সঙ্গে শিশু সন্তান রয়েছে, তাদের সমস্যা তো আরও এককাঠি উপরে! আমারই এক বান্ধবী একবার জানিয়েছিল, শিশুসন্তানকে সামলাতে গিয়ে রান্না করার সুযোগ না পেয়ে কোনো কোনো দুপুরে না খেয়ে থাকতে হয়েছে তাকে!

অধিকাংশ শিশু, যাদের মা গৃহিণী, তাদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, উত্তরে বলবে- ‘আমার মা কিছুই করে না’। এই কথাটি সে নিজ থেকে বানিয়ে বলছে না। সে দেখছে, চারপাশের মানুষেরা কেউ গৃহিণীর কাজকে কাজ মনে করে না, তাদের কাজের কোনো মূল্যায়ণ নেই। যেহেতু গৃহিণীর কাজের আলাদা কোনো মূল্যায়ণ নেই, তাই সবকিছু সামলেও তাদের জায়গা হয় ‘কিছু না করা’দের দলে!

চিন্তা করে দেখুন তো, যিনি সংসারের অভ্যান্তরীণ দিকটা সামলান, ক‘টা দিন তিনি তার কাজ বন্ধ রাখলে চিত্রটি কীরকম দাঁড়াবে? এরকম একটি গল্প আছে- এক লোক অফিস শেষে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখলেন তাদের তিনটি শিশু সন্তান বাসার সামনে ধুলোবালির স্তুপে বসে খেলা করছে। তাদের সমস্ত পোশাক নোংরায় মাখামাখি। তিনি আতংকিত মনে ঘরের ভেতরে ঢুকলেন। দেখতে পেলেন, রান্নাঘরে নোংরা বাসনের স্তুপ, গতরাতে খাওয়ার পরে সেগুলো আর পরিষ্কার হয়নি। গোসলখানার কল থেকে পানি পড়েই যাচ্ছে; সারা ঘরে ছেঁড়া কাগজ, অন্যান্য আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে! স্ত্রীর কিছু হয়নি তো! এমন আশঙ্কা নিয়ে ভয়ে ভয়ে শোবার ঘরের দিকে এগুলেন। সেখানে গিয়ে দেখতে পেলেন তার স্ত্রী আধশোয়া হয়ে বই পড়ছেন নির্ভাবনায়। তিনি তখন এসবের কারণ জানতে চাইলেন। স্ত্রী বললেন, ‘তুমি তো প্রতিদিনই আমাকে বলো, আমি নাকি কোনো কাজই করি না। সারাদিন পায়ের ওপর পা তুলে আরাম করি। আজ আমি সারাদিন তাই করেছি, যা তুমি আমাকে প্রতিদিন বলো। আর তার ফলাফলই দেখতে পাচ্ছো!’ লোকটি তখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাইলেন।

স্যালারি ডট কম-এর ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যেক গৃহিণী, অর্থাৎ যারা চাকরি করেন না, এমন মায়েরা সপ্তাহে গড়ে ৯৪ ঘণ্টা কাজ করেন। গাড়িচালক, মনোবিজ্ঞানী এবং অন্য অনেকের কাজের চেয়ে যা প্রায় দ্বিগুণ। এক সপ্তাহে একজন চিকিৎসক ৫৬ ঘণ্টা কাজ করলে মাসে পান ১ লাখ ৫৩ হাজার মার্কিন ডলার। সেই অনুযায়ী গৃহিণীদের সপ্তাহে ৯৪ ঘণ্টা কাজের হিসেবে বছরে কত বেতন হওয়া উচিত? স্যালারি ডট কম বলছে, গৃহিণীরা ৯টা থেকে ৫টা কাজের বাইরে সপ্তাহে যে অতিরিক্ত ৫৮ ঘণ্টা খাটেন, সেটা হিসেব করলে তাদের বাড়তি বেতন হওয়া উচিত বছরে ৬৭,৪৩৬ মার্কিন ডলার।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বলছে, বাংলাদেশে একজন নারী প্রতিদিন গড়ে ১২ দশমিক ১টি কাজ করেন। পুরুষদের ক্ষেত্রে এ কাজের গড় সংখ্যা ২ দশমিক ৭। গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের নারীদের বার্ষিক মজুরিবিহীন গৃহকাজের অর্থনৈতিক মূল্য প্রায় ১ লাখ ১১ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা।

আমাদের দেশে বেতন তো দূরে থাক, নারীর কাজকে ‘কাজ’ হিসেবেই স্বীকৃতি দেয়া হয় না। বর্তমানে এই ধারণা কিছুটা বদলাতে শুরু করেছে বটে, কিন্তু তা নেহায়েতই নগন্য। অনেকসময় দেখা যায় স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরিজীবী কিন্তু ঘরে ফিরে ঘরের কাজ স্ত্রী একাই সামলাচ্ছেন! কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষটি যদি তার স্ত্রীকে কাজে সাহায্য করেন, তখন তাকে চারপাশ থেকে টিটকারি শুনতে হয়!

এটা মেয়েদের কাজ, এটা ছেলেদের কাজ- এই বিভাজন দূর করতে হবে। জীবনধারণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তাগুলো যেহেতু দুজনেরই মোটামুটি এক, ক্ষুধা যেহেতু দুজনেরই লাগে তাই কাজগুলোও দুজন মিলে ভাগ করে নেয়া উত্তম। এক্ষেত্রে যে যে কাজটিতে বেশি পারদর্শী, তাকে সেই কাজটি করতে দিলেই হয়। বিনা পয়সায়, বিনা স্বীকৃতিতে নারীর এই খাটুনি বন্ধ হোক। সংসার কারও একার নয়, বরং নারী-পুরুষ দুজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমে যে সুখের ঘরটি রচিত হয়, তাকেই আমরা সংসার বলি।

শেয়ার করুন »

মন্তব্য করুন »