বার্তাবাংলা ডেস্ক :: বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের পুরুষদের মাঝেও নারীর প্রতি সহিংস মনোভাব দিন দিন বাড়ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ সেলের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রায় এক যুগে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৬৫ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আর ইউনিসেফের তথ্য অনুসারে দক্ষিণ এশিয়ার কিশোরী নির্যাতনের হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে।
অস্বাভাবিক বেড়ে চলা এই নারী সহিংসতার হার কমিয়ে আনতে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ২০০৯ সালের ১৪ মে একটি যুগান্তকারী রায় প্রদান করেন। রায়ের পাশাপাশি আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধের একটি নির্দেশনাও প্রদান করেন।
কিন্তু রায় পরবর্তী প্রায় পাঁচ বছরেরও বেশি সময় কেটে গেলেও সে নির্দেশনা এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। অনেকটা ধীর গতিতে চলছে এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। ফলে সমাজে নারীদেরকে এখনো সহিংস মনোভাব শিকার হতে হচ্ছে।
এর আগে বাংলাদেশে যৌন হয়রানি ও নারী নির্যাতন হার হ্রাস করতে বাংলাদেশ ন্যাশনাল উইমেন লইয়ারস অ্যাসোসিয়েশনসহ (বিএনডব্লিউএলএ) বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান হাইকোর্টে এ সংক্রান্ত রিট পিটিশন (নম্বর-৫৯১৬/২০০৮) দায়ের করেছিলেন।
ওই রিট আবেদনে আদালতের সামনে কয়েকটি ঘটনা ও বিষয় বেশ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছিলো। এর মধ্যে ২০০৬ সালের ১৬ নভেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী যৌন হয়রানির অভিযোগ ছিল। এর কিছু দিন আগে একই অপরাধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ বিভাগের এক শিক্ষকের পদত্যাগের ঘটনাও উল্লেখ করা হয়। এছাড়াও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দিলারা চৌধুরীর যৌন হয়রানির ওপর গবেষণাধর্মী ও প্রকাশিত একটি বইয়ে সীমি, তৃষা, ফারজানা ও আফরিনের মতো অসংখ্য প্রাণ কিভাবে ক্রমাগত অকালে ঝরে গেল তাও আদালতের সামনে তুলে ধরা হয়।
২০০১ সালে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে ৩৭০০ গার্মেন্ট আছে, যার অধিকাংশই ঢাকায় অবস্থিত এবং এই গার্মেন্টের শতকরা ৮৮ ভাগ কর্মীই নারী, যারা প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলেও রিট আবেদনে উল্লেখ করা হয়।
রিট আবেদনে পেশাজীবী দুইজন নারী চাকরিজীবীর বক্তব্যও তুলে ধরা হয়। বলা হয়, সাবিহা (ছদ্মনাম) একজন এনজিওকর্মী। ২০ বছর ধরে একটি এনজিওতে কাজ করছেন। তিনি দুই বার তাঁর অফিসের সুপারভাইজার দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। সুপারভাইজার চাকরি হারিয়েছেন। সুনেত্রা (ছদ্মনাম) বয়স ৩০। তিনি অবিবাহিতা। মিডিয়াকর্মী। তিনিও সহকর্মী দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। এ কারণে তাঁকে চাকরি ছাড়তে হয়েছে।
এভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যৌন হয়রানির ঘটনা ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে হাইকোর্টকে অবগত করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে আদালত তার রায়ে যৌন হয়রানির প্রতিরোধে যুগান্তকারী কিছু সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার ঘোষণা দেন এবং তা বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ আইনজীবী সমিতির ওপর দায়িত্ব হস্তান্তর করেন।
নির্দেশনা অনুসারে যৌন হয়রানী রোধে কমিটি গঠন, থানায় অভিযোগ গ্রহণ ছাড়াও সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিল্প কল-কারখানা এবং সরকারি- বেসরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত ব্যবস্থা এবং সুপারিশ প্রণয়নে যৌনহয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। দুই বছর মেয়াদি এই কমিটি হবে সাত সদস্যের। গ্রহণযোগ্য ও সমাজে আস্থাভাজন ব্যক্তি এই কমিটির সদস্য থাকবেন। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, উপজেলা, জেলা প্রশাসক, এবং মেট্রোপলিটন এলাকার থানার প্রতিনিধি থাকবে।
গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে আহ্বায়ক করে আইনজীবী, নারী অধিকার সম্পর্কে অভিজ্ঞ মানবাধিকার কর্মী, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দুইজন প্রতিনিধি, সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কর্ম প্রতিষ্ঠান বা প্রশাসনিক থানা এলাকার দুইজন প্রতিনিধি সদস্য থাকবেন। পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, জনপ্রতিনিধিদের মধ্য থেকে একজন প্রতিনিধি হবেন সদস্য সচিব।
কমিটির কাছে অভিযোগ দাখিল: কমিটির কাছে অভিযোগকারী যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কমিটির কাছে অভিযুক্তের কাছে ঘটনার অভিযোগ দাখিল করবেন।
কমিটির কাজ: কমিটি তদন্ত করে প্রতিবেদনসহ সুপারিশ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেবে। যৌন হয়রানি বারবার ঘটলে সরাসরি আইনগত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অথবা থানায় অফিসার ইন- চার্জের কাছে প্রদান করবে।
যদি কমিটির কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ দাখিল করা হয় সে ক্ষেত্রে সাত কর্ম দিবসের মধ্যে ওই সদস্যকে কমিটি থেকে অব্যাহতি দিয়ে নতুন সদস্যকে নিয়োগ দিতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ট সদ্যের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে কমিটি।
অভিযোগ তদন্ত: কমিটি তদন্ত করার জন্য উভয় পক্ষকে নোটিশ জারি করবে এবং শুনানি করবে। তথ্য, সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ দলিল পর্যালোচনা করবে। প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াও পারিপার্শিক সাক্ষ্য প্রমাণের ওপর জোর দেবে কমিটি।
অভিযোগকারীর পরিচয় গোপন রাখবে এবং সাক্ষ্য গ্রহণকালে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে হেয়, নিগ্রহ ও হয়রানিমূলক প্রশ্ন করা যাবে না।
৩০ কার্যদিবসের মধ্যে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ পেশ করবে। বিশেষ কারণে তদন্ত কাজ ৬০ দিন বাড়াতে পারবে কমিটি।
তদন্ত কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সব ধরনের সহায়তা চাওয়ামাত্র দিতে বাধ্য থাকবে।
ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ: শিক্ষার্থী হলে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী মৌখিক সতর্ক, লিখিত সতর্ক, বহিষ্কার এবং সকল শিক্ষা ও কর্ম প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ক তথ্য সরবরাহ এবং ক্ষতিপূরণের জন্য দেওয়ানি মামলা এবং শাস্তির জন্য ফৌজদারি মামলা করার সুপারিশ করবে কমিটি।
অপরাধী যদি কর্মকর্তা হন সে ক্ষেত্রে অপরাধের মাত্রা মৌখিক সতর্ক, লিখিত সতর্ক, বহিষ্কার ও প্রচার, ইনক্রিমেন্ট বন্ধসহ সব ধরনের আর্থিক সুবিধা খর্ব করা এবং উচ্চ শিক্ষা বা উচ্চ প্রশিক্ষণ বা পদোন্নতি স্থগিত করা এবং পদাবনতি করার সুপারিশ করবে কমিটি।
অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় বাধ্যতামূলক অবসর বা চাকরিচ্যুত করা, নৈতিক অসততার দায়ে চাকরিচ্যুত বা শাস্তির বিষয় সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানে অবহিত করা এবং ক্ষতিপূরণের জন্য দেওয়ানি মামলা এবং শাস্তির জন্য ফৌজদারি মামলা করার সুপারিশ করবে কমিটি।
বিচার ও আদালতের ক্ষমতা: ফৌজদারি আইনে (১৮৯৮ সালের ৫ ধারা) যা কিছু থাকুক না কেনো এ আইনের আওতায় সব আদেশ আদালত কর্তৃক প্রদত্ত হবে। অন্য আইনে যা কিছুই থাকুক, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সংশ্লিষ্ট অপরাধ সম্পর্কিত প্রচলিত আইনের দণ্ড দিতে পারবেন।
সুপারিশ অমান্য করার শাস্তি: শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্ম প্রতিষ্ঠান প্রধান কমিটির সুপারিশ না মানেন, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে অবহেলা করেন তাহলে প্রধান নির্বাহীর কমপক্ষে এক মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আর আদায় করা অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত অভিযোগকারীকে ১০ দিনের মধ্যে দিতে হবে।
মিথ্যা অভিযোগ দাখিলের শাস্তি: অভিযোগ দাখিল করার ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নেই জেনেও উদ্দেশ্যমূলকভাবে অভিযোগ দাখিল করলে অনধিক দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। মিথ্যা অভিযোগ নিয়ে কোনো ব্যক্তির লিখিত অভিযোগ নিয়ে আদালত অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ ও বিচার করবে।
সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশে বাধা-নিষেধ: যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের বিষয়ে নারী ও শিশুর নাম, ঠিকানা এবং অন্যান্য তথ্য প্রকাশ করলে অনধিক দুই মাস কারাদণ্ড বা ২০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
হাইকোর্টের এমন নির্দেশনা সত্ত্বেও বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। তাই সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা মার্কেট যাই হোক না কেন, সেখানে যৌন হয়রানি বন্ধে তদন্ত কমিটিতো দূরের কথা একটি অভিযোগ বক্সেরও সন্ধান পাওয়া যায়নি এ পর্যন্ত। এতে প্রমাণিত আদালতের নির্দেশনা এখনো উপেক্ষিত।
তবে আদালতের নির্দেশনা অনুসারে বিষয়টি ধীর গতিতে হলেও বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয়েছে।
সংস্থা থেকে জানা যায়, তারা গত দুই বছর আগে ৫০টিরও বেশি ইউনিভার্সিটি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী এ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। পরিসংখ্যান ব্যুরো, নারী ও শিশু নির্যাতন অধিদপ্তরসহ বেশ কিছু সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বন্ধে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া তাদের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়েছিলো। বর্তমানে এই কার্যক্রম থেমে নেই এবং সব প্রক্রিয়া ধীর গতিতে হলেও চলছে বলে সংস্থাটি জানায়।