জলবায়ু পরিবর্তন এখন একটি বৈশ্বিক সংকট হিসেবে স্বীকৃত, যা মানবজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো এই প্রভাবের প্রতি বিশেষভাবে সংবেদনশীল, কারণ এদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, ঘনবসতিপূর্ণ জনসংখ্যা, এবং সীমিত স্বাস্থ্য অবকাঠামো এটিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা এক নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। এ প্রবন্ধে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের ওপর পরিণতি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সামনে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ, এবং এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গৃহীত পদক্ষেপ ও প্রয়োজনীয় নীতিমালা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যাসমূহ
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যে সমস্যা দেখা দিচ্ছে, তা মূলত তিনটি প্রধান দিকের উপর নির্ভর করছে: ১) জলবায়ু-সম্পর্কিত রোগের বৃদ্ধি, ২) খাদ্য ও পানির নিরাপত্তার সংকট, এবং ৩) তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত স্বাস্থ্য ঝুঁকি।
১. জলবায়ু-সম্পর্কিত রোগের বৃদ্ধি
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে কিছু নির্দিষ্ট রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব রোগের মধ্যে প্রধানত পানিবাহিত রোগ, ভেক্টরবাহিত রোগ, এবং তাপদাহজনিত রোগ অন্তর্ভুক্ত।
পানিবাহিত রোগ
বাংলাদেশে বর্ষাকাল এবং বন্যা মৌসুমে পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব অত্যন্ত সাধারণ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যা এবং অতিবৃষ্টির মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড এবং হেপাটাইটিস-এর মতো পানিবাহিত রোগগুলোর প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। এসব রোগ প্রধানত দূষিত পানি পান এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে ছড়ায়। গ্রামীণ এবং উপকূলীয় এলাকাগুলোতে মিঠা পানির সংকট এবং নিরাপদ স্যানিটেশনের অভাবের কারণে এই রোগগুলো আরও মারাত্মক আকার ধারণ করছে।
অতিবৃষ্টির ফলে যেসব এলাকায় বন্যা হয়, সেখানে পানি সরবরাহের লাইনগুলো দূষিত হয়ে পড়ে, যা পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া, অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ এবং অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। বন্যার পরে পানির সরবরাহ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থার অবনতি জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের হুমকি সৃষ্টি করে। শহরাঞ্চলে এই ধরনের সংকটের ফলে শিশু এবং বয়স্করা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ভেক্টরবাহিত রোগ
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাতের প্যাটার্ন পরিবর্তিত হচ্ছে, যা ভেক্টরবাহিত রোগের (যেমন ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া) বিস্তারকে ত্বরান্বিত করছে। বিশেষ করে, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। উষ্ণ এবং আর্দ্র আবহাওয়া মশার বংশবৃদ্ধির জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে, যার ফলে এই রোগগুলোর প্রকোপ বাড়ছে।
ঢাকার মতো বড় শহরগুলোতে ডেঙ্গু একটি নিয়মিত এবং মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এখানে বছরে কয়েক হাজার মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়, যা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করে।
গ্রামীণ এলাকায় ম্যালেরিয়া এবং চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছানো কঠিন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মশার প্রজনন ক্ষেত্র বাড়ছে এবং রোগের বিস্তার দ্রুত ঘটছে।
তাপদাহজনিত রোগ
বাংলাদেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাপদাহজনিত রোগের প্রকোপও বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষ হিট স্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন, এবং অন্যান্য তাপজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে, যেখানে ঘনবসতি এবং পরিবেশ দূষণের মাত্রা বেশি, সেখানে তাপদাহের প্রভাব আরও বেশি পরিলক্ষিত হয়। এই ধরনের পরিস্থিতি জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে, বিশেষ করে বয়স্ক এবং শিশুদের জন্য।
উচ্চ তাপমাত্রা শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাপদাহের কারণে বৃদ্ধ এবং অসুস্থ ব্যক্তিদের অবস্থা আরও খারাপ হয়, যা তাদের জীবনযাত্রার মানকে নষ্ট করে। তাপদাহের কারণে কর্মক্ষমতা হ্রাস পায় এবং অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতাও কমে যায়। এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
২. খাদ্য ও পানির নিরাপত্তার সংকট
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের খাদ্য এবং পানির নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। এ সংকটের কারণে জনস্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
খাদ্য নিরাপত্তা
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের কৃষি খাতে বন্যা, খরা, এবং লবণাক্ততার প্রভাব মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব প্রভাবের কারণে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে। বিশেষ করে, ধান, গম, এবং অন্যান্য প্রধান ফসলের উৎপাদন কমে যাওয়ায় দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী অপুষ্টির ঝুঁকিতে পড়ছে।
অপুষ্টি শুধুমাত্র শিশুদের নয়, প্রাপ্তবয়স্কদেরও বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যার মধ্যে আয়রন স্বল্পতা, ভিটামিনের অভাব এবং বিভিন্ন সংক্রামক রোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষিজমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে এবং উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। ফলে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পেয়ে খাদ্য সংকট তৈরি হচ্ছে। এই সংকট আরও গভীর হলে অপুষ্টি এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সমস্যা প্রকট হয়ে উঠতে পারে। এর ফলে জনগণের স্বাস্থ্য এবং দেশের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
পানি নিরাপত্তা
বাংলাদেশের উপকূলীয় এবং গ্রামীণ এলাকাগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং মিঠা পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। ফলে, নিরাপদ পানীয় জলের অভাব একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানি নিরাপত্তাহীনতার কারণে পুষ্টির অভাব, ডায়রিয়া, এবং অন্যান্য পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়ছে।
উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার কারণে কৃষিকাজ এবং মিঠা পানির প্রাপ্যতা হ্রাস পেয়েছে। ফলে, স্থানীয় জনগোষ্ঠী জীবিকা নির্বাহের জন্য অন্যান্য অঞ্চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এর ফলে সামাজিক অস্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিতে পারে। পানি সংকটের কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকে।
৩. তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত স্বাস্থ্য ঝুঁকি
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে, গ্রীষ্মকালে তাপদাহের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা তাপজনিত স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করছে। উচ্চ তাপমাত্রার কারণে হিট স্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন, এবং অন্যান্য তাপজনিত রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। এছাড়াও, উচ্চ তাপমাত্রা শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, যা বিশেষ করে শিশু এবং বয়স্কদের জন্য মারাত্মক হতে পারে।
গ্রীষ্মকালে অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে কর্মক্ষমতা হ্রাস পায় এবং অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতাও কমে যায়। বিশেষ করে যারা শারীরিক পরিশ্রমমূলক কাজে নিয়োজিত, যেমন কৃষক, নির্মাণ শ্রমিক, এবং অন্যান্য খেটে খাওয়া মানুষ, তারা তাপদাহের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্ভূত জনস্বাস্থ্য সমস্যাগুলো বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মূলত তিনটি প্রধান ক্ষেত্রে দেখা যায়: ১) স্বাস্থ্য সেবার প্রাপ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা, ২) চিকিৎসা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, এবং ৩) স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা ও প্রস্তুতি।
১. স্বাস্থ্য সেবার প্রাপ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় এখনও প্রায় ৫০% মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। গ্রামীণ এবং দূরবর্তী এলাকায় বসবাসরত মানুষেরা প্রায়শই স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত থাকে, কারণ সেখানে সঠিক অবকাঠামো এবং প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও জটিল হয়ে ওঠে।
স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্য অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং প্রশিক্ষিত কর্মীদের নিয়োগ জরুরি। এছাড়াও, স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যসেবার প্রাথমিক পর্যায়ে পদ্ধতিগত উন্নয়ন করা প্রয়োজন। গ্রামীণ এলাকায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং হাসপাতাল নির্মাণের পাশাপাশি, স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন।
২. চিকিৎসা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্ভূত রোগ এবং স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর দ্রুত চিকিৎসা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। বিশেষ করে, ভেক্টরবাহিত রোগ এবং পানিবাহিত রোগের চিকিৎসায় পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং ওষুধের অভাব রয়েছে।
অ্যাম্বুলেন্স সেবা, ফাস্ট রেসপন্স টিম এবং অন্যান্য জরুরি চিকিৎসা সেবা বৃদ্ধির মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবা দ্রুত এবং কার্যকরভাবে প্রদান করা সম্ভব। এছাড়াও, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং স্থানীয় জনগণের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্তকরণ এবং প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এটি শুধু রোগ প্রতিরোধেই নয়, রোগ নিরাময়ে দ্রুত কার্যকর হতে পারে।
৩. স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা ও প্রস্তুতি
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্ভূত স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর মোকাবেলায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রস্তুতি এখনও অপর্যাপ্ত। বিশেষ করে, বড় ধরনের দুর্যোগ বা মহামারীর ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থার জরুরি প্রস্তুতি এবং সমন্বয় প্রয়োজন।
স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থাপনা এবং প্রস্তুতির ক্ষেত্রে স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো মোকাবেলায় যথাযথ নীতি, পরিকল্পনা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা প্রয়োজন। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জরুরি সেবা প্রদান, এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের ব্যবস্থাপনা।
সংকট মোকাবেলায় পদক্ষেপ ও নীতিমালা
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের ওপর যে প্রভাব পড়ছে, তা মোকাবেলায় সরকার, স্থানীয় সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং নীতিমালা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে, এই পদক্ষেপগুলো কার্যকর করতে এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং সমন্বিত নীতি গ্রহণ করা অপরিহার্য।
১. জনস্বাস্থ্য অবকাঠামোর উন্নয়ন
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামোকে শক্তিশালী করতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। বিশেষ করে, গ্রামীণ এবং উপকূলীয় এলাকাগুলিতে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র এবং হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। তবে, এই অবকাঠামোর উন্নয়ন আরও বাড়ানো প্রয়োজন, যাতে স্বাস্থ্যসেবা আরও সহজলভ্য হয়।
স্বাস্থ্য অবকাঠামোর উন্নয়নের পাশাপাশি, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো উচিত। এছাড়াও, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। উন্নত দেশগুলো থেকে স্বাস্থ্য প্রযুক্তি এবং জ্ঞান স্থানান্তরিত করে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা যেতে পারে।
২. জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষা
জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো মোকাবেলায় জনসচেতনতা এবং শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্থানীয় জনগণকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ঝুঁকির বিষয়ে সচেতন করা এবং তাদের প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণে উৎসাহিত করা প্রয়োজন।
এছাড়াও, স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করে জনগণের স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানো উচিত। উদাহরণস্বরূপ, ভেক্টরবাহিত রোগ প্রতিরোধে মশারি ব্যবহার, সঠিক স্যানিটেশন বজায় রাখা এবং নিরাপদ পানি পান করার মতো কার্যক্রমে জনগণকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। স্কুল এবং কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা যেতে পারে, যা ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিতে সহায়ক হবে।
৩. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং নীতি গ্রহণ
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্ভূত স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য তহবিল এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে, যা স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে।
প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক জলবায়ু নীতিতে অংশগ্রহণ করছে এবং এই চুক্তির আওতায় বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রকল্প গ্রহণ করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সহায়তা আরও বাড়ানো প্রয়োজন, যাতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা যায়। এছাড়া, স্বাস্থ্যসেবা খাতে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা যেতে পারে।
সমাপ্তি
জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। পানিবাহিত রোগ, ভেক্টরবাহিত রোগ, খাদ্য এবং পানি নিরাপত্তাহীনতা, এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় সরকার, স্থানীয় সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
স্বাস্থ্য অবকাঠামোর উন্নয়ন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা এই সংকট মোকাবেলায় সক্ষম হতে পারি। তবে, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং সমন্বিত নীতি গ্রহণের মাধ্যমে শুধুমাত্র আমরা বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের চ্যালেঞ্জগুলোকে কাটিয়ে উঠতে এবং দেশের জনগণের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারব।
এছাড়াও, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় একটি সমন্বিত এবং টেকসই নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং সংস্থান বৃদ্ধি করে আমরা এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে পারি এবং ভবিষ্যতে একটি স্বাস্থ্যকর সমাজ গড়ে তুলতে পারব।