ফারজানা তন্বী »

কভিড-১৯ পজিটিভ রোগীরা আক্রান্ত হওয়ার বেশ কিছুদিন পর নেগেটিভ হলেও মিলছে না নিষ্কৃতি। আপাতত সুস্থ হওয়া রোগীদের দেখা দিচ্ছে নানা শারীরিক উপসর্গ। কভিড-পরবর্তী শারীরিক নানা জটিলতা ও করণীয় বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন মার্কস মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. জুলহাস উদ্দিন

জ্বর

কিছু রোগী করোনা জয়ের পরও কিছুদিন ধরে জ্বরে ভুগতে পারেন, যদিও সেটি সাধারণত স্বল্পমাত্রার হয়ে থাকে। জ্বর পরিমাপ করলে হয়তো থার্মোমিটারে আসবে না; কিন্তু গায়ে জ্বর জ্বর অনুভব হতে পারে। এ ধরনের উপসর্গ থাকলে যা করতে হবে তা হলো :

► কয়েক দিন পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে।

► শরীর ও মাথা ব্যথা থাকলে প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধ একটি করে দিনে তিনবার সেবন করতে পারেন।

► জ্বর না কমলে টাইফয়েড, ইউটিআই বা প্রস্রাবের প্রদাহ হয়েছে কি না পরীক্ষা করুন।

► প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন।

► দেহে মোটেই ঘাম জমতে দেবেন না।

► ব্যবহার করা জামাকাপড়, বিছানাপত্র ইত্যাদি নিয়মিত ধৌত করার পাশাপাশি ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন।

কাশি

কভিডে আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগী দ্রুত এবং পূর্ণাঙ্গ সেরে উঠেছেন মনে করলেও কিছু ক্ষেত্রে বেশ কিছুদিন তাঁদের কাশির উপসর্গ থেকে যেতে পারে। বিশেষ করে শুকনা কাশি, হালকা বুক ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট থাকতে পারে। এসব রোগীর ক্ষেত্রে করণীয় হলো :

► যাঁদের আগে থেকেই কাশির সমস্যা ছিল, অ্যালার্জি ও অ্যাজমার ইতিহাস আছে, তাঁদের তেমন টেনশন করার দরকার নেই। এমন রোগীরা আগের ওষুধগুলো চালিয়ে যান।

► কভিড-পরবর্তী সময়ে কাশির জন্য উপসর্গভিত্তিক ওষুধ, যেমন—Tab. Fexofast 120/180 মিলিগ্রাম দিনে এক বা দুইবার, Mucolyte অথবা Ambolyte সিরাপ দুই চামচ করে দিনে দুইবার সপ্তাহখানেক খেতে পারেন।

► পালস অক্সিমিটার দিয়ে রক্তের অক্সিজেন স্যাচুরেশন মাপুন। স্যাচুরেশন ৯০ থেকে ৯২-এর নিচে নেমে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। তবে বেশি টেনশনের কারণ নেই। কেননা দ্বিতীয়বার অ্যাক্টিভ কভিভ ইনফেকশনের ঝুঁকি খুবই কম।

ক্লান্তি, অবসন্নতা

এমন কিছু রোগী আছেন, যাঁদের গুরুতর ক্লান্তি এবং অবসন্নতা দেখা দিতে পারে। এসব উপসর্গ তিন থেকে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। করোনায় আক্রান্তকালে তুলনামূলক কম খাদ্য গ্রহণ, আইসোলেশনে থাকা, বেশিদিন ধরে বিছানায় শুয়ে থাকা ইত্যাদি কারণেই এ ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। কেননা কভিড-১৯-এর আক্রমণক্ষমতা অন্যান্য করোনাভাইরাসের চেয়ে অনেক বেশি। এসব ক্ষেত্রে কিছু করণীয় হলো :

► প্রচুর পানি এবং সুষম খাবার গ্রহণ করুন।

► আস্তে আস্তে হালকা ব্যায়াম করুন। মানসিক শক্তিকে সব সময় চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করুন।

► চিকিৎসকের পরামর্শে ভিটামিন ‘বি’ কমপ্লেক্স, জিংক, আয়রন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘ডি’, মাল্টিভিটামিন নিয়মিত কয়েক সপ্তাহ সেবন করুন।

► দীর্ঘমেয়াদি ক্লান্তি ও অবসন্নতার সঙ্গে যদি কাশিও থাকে, সে ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে দুইবার পরীক্ষা করে নিশ্চিত হোন যে করোনামুক্ত হয়েছেন কি না।

► খুব বেশিদিন অবসন্নতা ও হাঁটাচলার দুর্বলতা থাকলে ফিজিওথেরাপি নিতে পারেন।

গা ব্যথা, মাথা ব্যথা ও বেশি ঘাম হওয়া

যেহেতু কভিড-১৯ রোগটি অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধির মতো একটি রোগ, সেহেতু সংক্রমিত হওয়ার পর রোগীরা ভালো হয়ে গেলেও শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা, বেশি বেশি ঘাম হওয়া ইত্যাদির সমস্যা থেকে যেতে পারে। তখন ইমিউনিটির বেশ ব্যাঘাত ঘটে, পুরো মেটাবলিক সিনড্রোম এলোমেলো হয়ে যায়। ফলে বিভিন্ন বাইপ্রডাক্ট রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এই ধরনের সমস্যাগুলো সৃষ্টি করতে পারে। এ জন্য কিছু করণীয় হলো :

► বেশি ঘাম মানেই শরীর থেকে লবণ বের হয়ে যাওয়া অর্থাৎ সোডিয়াম কমে যাওয়া। সে ক্ষেত্রে ওরস্যালাইন, ডাবের পানি এবং ফলমূল বেশি করে খেতে হবে। তবে উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা লবণ হিসাব করে খাবেন এবং ওষুধ সেবনের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখবেন।

► গা ব্যথা, মাথা ব্যথার জন্য প্যারাসিটামলের পাশাপাশি ভিটামিন ডি/ডি৩ খেতে পারেন। ক্যাপসুল D-Rise (৪০০০০ ইউনিট) সপ্তাহে একটি করে ছয় থেকে সাত সপ্তাহ খেতে পারেন।

► মনোবল হারাবেন না, ধৈর্য ধরুন। দেখবেন আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।

মানসিক সমস্যা

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণ বা কভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগীরা আপাত সুস্থ হয়ে গেছেন মনে হলেও সাময়িকভাবে বাড়তে পারে ডিপ্রেশন এবং অ্যাংজাইটির মতো মানসিক অস্থিরতার রোগগুলো। চিকিৎসক সুস্থ ঘোষণা করলেও তাঁরা এই সময় আতঙ্কে থাকেন যে এই বুঝি আবার হলো! এর সঙ্গে অন্য কোনো উপসর্গ দেখা দিলে সমস্যা আরো বেড়ে যায়। এই সময় পুরো নার্ভাস সিস্টেমের ওপর প্রভাব পড়ে। এসব ক্ষেত্রে করণীয় হলো :

► আগে থেকেই মানসিক সমস্যার জন্য ওষুধ খেয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

► টিভি দেখা, বই পড়া, পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ বা মেলামেশা থেকে শুরু করে সর্বদা হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করুন।

► ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে কম মাত্রায় ও কম সময়ের জন্য Tab. Angenta একটি করে সকালে ও দুপুরে এবং Tab. Revotril .5 মিলিগ্রাম একটি করে রাতে শোবার সময় খেতে পারেন।

শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা

কভিড-১৯ সাধারণত শ্বাসতন্ত্রের জটিল একটি রোগ। এতে শ্বাসতন্ত্রের মূল অঙ্গ ফুসফুসের ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা দীর্ঘ সময়, এমনকি স্থায়ীভাবে কিছু সমস্যাও থেকে যেতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লং ফাইব্রোসিস অর্থাৎ গোটা ফুসফুসের সংক্রমণে রোগীর একটু পরিশ্রমে হাঁপিয়ে যাওয়া, বুক ধড়ফড় করা, মাথা ঘোরানো ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এসব সমস্যায় করণীয় হলো :

► বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ফলোআপে থাকুন। প্রয়োজন হলে চেস্ট এক্স-রে করে দেখান।

► মাঝেমধ্যে পালস অক্সিমিটার দিয়ে অক্সিজেন স্যাচুরেশন দেখুন।

► বুক ফোলানো বা শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করুন।

► প্রয়োজনে বাসায় অক্সিজেন মেশিনের মাধ্যমে Oxygen (O2) inhalation লাগতে পারে।

► সম্পূর্ণরূপে ধূমপান পরিহার করুন।

► সিওপিডি, ব্রংকাইটিস, অ্যাজমা ইত্যাদি রোগ থাকলে অবহেলা না করে সেগুলোর যথাযথ চিকিৎসা করুন।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে সুস্থ হওয়া রোগীরা পরবর্তী সময়ে নানা রোগে, বিশেষ করে অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধি, যেমন—এইডস, টিবি, ফাঙ্গাল ইনফেকশন ইত্যাদি রোগে ভুগতে পারেন। এসব সমস্যা দেখা দিলে করণীয় হলো :

► এই ভাইরাস এক ধরনের কেমিক্যাল-জাতীয় পদার্থের মেটাবলিজমের মাধ্যমে দেহের স্বাভাবিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ওলটপালট করে ফেলে। সুতরাং কনভালোসেন্স পিরিয়ডে পুষ্টিযুক্ত খাবার খাওয়া থেকে শুরু করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে—এ ধরনের কার্যাদি সম্পন্ন করুন।

► নিয়মিত একটু একটু ব্যায়াম করুন, শাকসবজি ও ফলমূল খান ইত্যাদি।

কো-মরবিডিটির প্রভাব

করোনা-উত্তর রোগীদের নিজেদের কো-মরবিডিটি অর্থাৎ কিছু ক্রনিক রোগ সম্পর্কে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে। যেমন—

ডায়াবেটিস : এটি এমন একটি রোগ, যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সরাসরি বিপরীতমুখী কাজ করে। সুতরাং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য যথাযথ ডায়েট, নিয়মিত হাঁটা, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি চিকিৎসকের ফলোআপে থাকা খুব জরুরি।

কিডনি রোগ : কিডনি রোগ নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি। কারণ এর সঙ্গে রক্তচাপ, ভিটামিন ‘ডি’, ক্যালসিয়াম, হিমোগ্লোবিনসহ অতীব স্পর্শকাতর ব্যাপারগুলো জড়িত। ডায়ালিসিস এবং ট্রান্সপ্লান্ট রোগীদের আরো সচেতন থাকতে হবে।

হৃদরোগ : হৃদরোগীরা, বিশেষ করে বাইপাস সার্জারি করা রোগীরা করোনায় আক্রান্ত হলে পুরো কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেমের সমস্যা হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে রক্তচাপ বেড়ে বা কমে গিয়ে শকেও চলে যেতে পারে। এসব রোগীকে জরুরিভাবে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বা কার্ডিয়াক সার্জনদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা উচিত।

শেয়ার করুন »

মন্তব্য করুন »