করোনা নামের আতঙ্ক পুরো পৃথিবীকে গ্রাস করে রেখেছে। পৃথিবী এই মহামারি থেকে কবে মুক্ত হবে তার নিশ্চয়তা নেই কারো কাছেই। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয় যেমন বড়দের প্রভাবিত করছে, তেমনি ছোটরাও একটি আতঙ্কিত সময় পার করছে।
ছোটদের মনের ওপরও পড়ছে এর নেতিবাচক প্রভাব। শিশুদের মন অনেক কোমল হয়। তারাও চাপের পরিস্থিতিতে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে, যা বড়দের থেকে একদমই ভিন্ন। বড়দের অনুভূতিগুলো পরিস্থিতির ধরন অনুযায়ী সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। কিন্তু শিশুরা তাদের ভালো লাগা-মন্দ লাগা বড়দের মতো করে প্রকাশ করতে পারে না।
যেহেতু শিশুদের অনুভূতি প্রকাশ বড়দের থেকে ভিন্ন, তাই যেসব পরিস্থিতিতে শিশু মানসিক চাপ অনুভব করে তখন দেখা যায় সে হঠাৎ খুব চুপ হয়ে যায় বা কোনো কাজ না করে চুপচাপ বসে থাকে। তখন তার কোনো কিছুই করতে ভালো লাগে না। খুব অস্থির হয়ে যেতে পারে বা হঠাৎ করে অনেক রেগে যেতে পারে।
এ সময় তাকে বকাঝকা করলে অনেক বেশি অভিমান বা কান্নাকাটি করতে পারে, বাসার বিভিন্ন জিনিস ছুড়ে তার রাগ প্রকাশ করতে পারে। এমনকি অনেক শিশু মানসিক চাপ থেকে রাতে ঘুমের মাঝে বিছানাও ভিজিয়ে ফেলতে পারে। তাই শিশুদের মনের যত্ন নেওয়ার দিকে বেশি মনোযোগী হতে হবে।
করোনায় সবাই একটি কঠিন সময় পার করছে। এই সময়ে বাচ্চাদের বিভিন্ন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া বা অনুভূতির প্রকাশকে শাসন বা কঠোরভাবে নেওয়া যাবে না। যখন দেখবেন আপনার শিশুর কোনো কারণে মন খারাপ বা সে কোনো কারণে ভীত, তখন তার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে আপনি তার অনুভূতি বুঝতে পেরেছেন এবং এর পেছনের কারণও বুঝতে পেরেছেন। আপনার শিশু কী চাচ্ছে তা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। তাকে তার অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে দিতে হবে।
তাদের প্রতি মানবিক হতে হবে, তাদের সমস্যার কথা মন দিয়ে শুনতে হবে এবং তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। অন্য সময়ের তুলনায় এই সময়ে তাদের দিতে হবে বেশি ভালোবাসা এবং তাদের প্রতি বেশি মনোযোগী হতে হবে। নিজের বা পরিবারের অন্যদের মানসিক চাপ, রাগ, উত্তেজনা, অস্থিরতা শিশুর সামনে প্রকাশ করা যাবে না। তাকে যতটুকু সম্ভব এগুলো থেকে দূরে রাখতে হবে এবং নিজেদের তার সামনে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে।
এই মুহূর্তে বড়দের মতো বাচ্চারাও গৃহবন্দি। যেহেতু তারা স্কুলে যেতে পারছে না, খেলার সঙ্গীদের সঙ্গে খেলতে পারছে না বা বাইরে কোথাও ঘুরতে যেতে পারছে না, তাই এই পরিস্থিতিতে বাড়ির অন্য সদস্যদের ভালোবাসা ও মনোযোগ তাদের অনেক বেশি প্রয়োজন। তাদের সঙ্গে বেশি বেশি সময় কাটাতে হবে, নরম সুরে কথা বলতে হবে, দয়াশীল হতে হবে, বারবার আপনার আচরণ দিয়ে তাকে আশ্বস্ত করতে হবে এবং আপনার উপস্থিতি ও প্রয়োজনে সব সময় পাশে থাকার ব্যাপারটা তাকে বোঝাতে হবে।
আপনার শিশুর দৈনন্দিন যে কাজকর্মগুলো ছিল, তা চালিয়ে যেতে হবে। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে তাতে সামান্য পরিবর্তন আনা যেতে পারে। যেহেতু এখন অনলাইনের মাধ্যমে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হচ্ছে, এর ফাঁকে ফাঁকে বাসায় খেলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
খেলার মাধ্যমে বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তার মন শান্ত থাকে এবং মানসিক চাপ ভুলে থাকে। বাসায় এমন কিছু খেলাধুলার আয়োজন করতে পারেন, যেটাতে আপনি ও আপনার বাচ্চা দুজনই অংশগ্রহণ করতে পারেন। ইন্টারনেট থেকে দেখে ক্রিয়েটিভ কিছু করার জন্য উৎসাহিত করতে পারেন, বাসার বিভিন্ন জিনিস দিয়ে নতুন কিছু বানানো শেখাতে পারেন, কাগজ দিয়ে অরিগ্যামি বানানো শেখাতে পারেন, আপনার বা বাসার অন্য সদস্যদের ছোটখাটো কোনো কাজে তাকে সাহায্য করার জন্য বলতে পারেন।
আপনার শিশু একটু বড় হলে তাকে নিয়ে প্রতিদিন হালকা কিছু ব্যায়াম করতে পারেন। সারাক্ষণ মোবাইল, ট্যাব বা ল্যাপটপে ব্যস্ত না রেখে হাঁটা, সাইকেল চালানো, দড়ি লাফ—এমন কিছু শারীরিক ব্যায়াম করার জন্য অনুপ্রাণিত করতে পারেন। যে কাজই করুক না কেন তা করার পর অবশ্যই তার প্রশংসা করতে হবে।
কোনোভাবেই শিশুর ঘুমের রুটিনে ব্যাঘাত ঘটানো যাবে না। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম পাড়াতে হবে এবং পর্যাপ্ত ও গভীর ঘুম যেন হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। বাচ্চাকে এই পরিস্থিতিতে একা সময় কাটাতে না দেওয়াই ভালো। পরিবারের যেকোনো একজন সদস্য যেন সব সময় আপনার বাচ্চার সঙ্গে থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। যদি করোনার কারণে বা অন্য কোনো অসুস্থতার কারণে আপনার শিশুকে হাসপাতাল বা অন্য কোথাও থাকতে হয়, তাহলে সব সময় তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করুন এবং তাকে আশ্বস্ত করে তার ভয় দূর করুন।
করোনাভাইরাস থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে বাচ্চারা অনেক নতুন জিনিস দেখতে বা শুনতে পাচ্ছে, যা তাদের মাঝে উদ্বেগ তৈরি করছে। যেহেতু বাকি সবার মতো এই পরিস্থিতি তাদের কাছেও নতুন, তাই এ ব্যাপারে তাদের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলতে হবে। তাদের পুরো ঘটনাটি বোঝাতে হবে এবং কিভাবে আমরা সতর্ক ও সাবধান থেকে এই রোগ থেকে রক্ষা পাব তা শেখাতে হবে।
তাদের সঙ্গে খেলার ছলে আপনি হাত ধোয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢাকা, মাস্ক পরিধান করার পদ্ধতি শেখাতে পারেন। পরিবারের কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাকে সুস্থ করার জন্য কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে (যেমন হাসপাতালে যাওয়া ও ডাক্তারের চিকিৎসা নেওয়া) তা সুন্দর করে বোঝাতে হবে, যাতে আপনার শিশু ঘাবড়ে না যায়। এই ছোট ছোট পদক্ষেপ আপনার শিশুর মানসিক যত্ন নিতে এবং তাকে মানসিক চাপমুক্ত রাখতে সহায়তা করবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়