মোহাম্মদ কামরুজ্জামান »

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ-প্রাপ্ত পলাতক পাঁচ খুনির মধ্যে দুজনকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তবে অন্য তিনজনের কে কোথায় অবস্থান করছেন তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকরের ১০ বছর পর সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে খুনি এএম রাশেদ চৌধুরী ও কানাডা থেকে এসএইচবিএম নূর চৌধুরীকে ফেরানোর ব্যাপারে আশাবাদী। রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্কাডেন এল এলপি নামে একটি আইনি পরামর্শক সংস্থাকে নিয়োগ করেছে সরকার।

যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া গত জুনে নাটকীয় মোড় নেয়। যুক্তরাষ্ট্রে ওই খুনির রাজনৈতিক আশ্রয়ের একটি মামলা দীর্ঘ ১৫ বছর বন্ধ থাকার পর দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম তা আবার চালু করেছেন। এর ফলে রাশেদ চৌধুরীর বিষয়ে দ্রুত কোনো সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এই মামলার সূত্র ধরে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় নেওয়ার বিষয়ে অনেক অমীমাংসিত আইনি বিষয়ও সমাধান হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সম্প্রতি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাঠাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রধানমন্ত্রী ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরতি চিঠিতে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি পুনরায় উল্লেখ করেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন গণমাধ্যমে বলেন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে চিঠি দিয়েছেন। আশা করছি আমরা সফল হব। মন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের একজন কানাডায় আছেন এবং আরেকজন যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। তাদের ফেরত আনার জন্য যা যা করার দরকার সেটি করব।

মন্ত্রী বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বঙ্গন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গত এপ্রিলে একটি শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান, যেখানে তিনি লেখেনÑ এ ধরনের নেতা পৃথিবীতে খুব কম দেখা যায়। এর পর প্রধানমন্ত্রী ফিরতি চিঠি পাঠান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের প্রত্যাশা এই মুজিববর্ষে একজনকে আনা হয়েছে এবং আরেকজনকে যেন আনতে পারি।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্রুত আলোচনায় বসতে চায় বাংলাদেশ। দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো পর্যালোচনার সর্বোচ্চ ফোরাম পার্টনারশিপ ডায়ালগের আওতায় সেই আলোচনা হতে পারে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর আইনি এবং প্রশাসনিক প্রক্রিয়া দ্রুততর করার জন্য আনুষ্ঠানিক আলোচনা জরুরি। সেপ্টেম্বরের শেষে বা অক্টোবরের শুরুতে সংলাপটি আয়োজন করতে চায় বাংলাদেশ।

অন্যদিকে খুনি নূর চৌধুরীকে দেশে ফেরানোর উদ্যোগে এক ধাপ অগ্রগতি হয়েছে কানাডার আদালতের এক রায়ে। নূর চৌধুরীকে দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের এক আবেদনে সাড়া দিয়েছেন কানাডার আদালত। বাংলাদেশ সরকারের করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে কানাডায় নূর চৌধুরীর অবস্থানসংক্রান্ত তথ্যের বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন দেশটির আদালত। গত বছরের সেপ্টেম্বরে কানাডার ফেডারেল কোর্টের বিচারকের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য দেশটির অটোয়া প্রশাসনকে এ নির্দেশ দেন। এর মধ্য দিয়ে কানাডার অটোয়া আইনি লড়াইয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে হেরে গেছে।

বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালে কানাডার অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরে চিঠি দিয়ে জানতে চায় নূর চৌধুরীর ‘প্রি-রিমুভাল রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট’-এর আবেদন কোন পর্যায়ে আছে; কিন্তু কানাডার আইনে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত কাউকে প্রত্যর্পণে বাধা থাকায় দেশটির সরকার জনস্বার্থ রক্ষার যুক্তি দিয়ে নূর চৌধুরী সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ না করার সিদ্ধান্তের কথা জানায়। ফলে গত বছরের জুনে ‘জুডিশিয়াল রিভিউয়ের’ আবেদন করে বাংলাদেশ। ওই মামলায় শুনানি করে বিচারক বাংলাদেশের পক্ষে রায় দেন। রায়ে বিচারক বলেন, নূর চৌধুরীর অভিবাসনসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশে জনস্বার্থের ব্যাঘাত ঘটবে না। সুতরাং নূর চৌধুরীর বিষয়ে বাংলাদেশকে তথ্য না দেওয়ার সিদ্ধান্ত কানাডা সরকারকে পুনর্বিবেচনা করতে হবে।

বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। গণমাধ্যমে পাঠানো এক ভিডিওবার্তায় তিনি বলেন, যতক্ষণ পলাতক পাঁচ খুনিকে দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের ফাঁসির রায় সম্পূর্ণ কার্যকর করতে না পারব, ততক্ষণ পর্যন্ত এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

তাদের ফিরিয়ে আনার পরই এ প্রচেষ্টার পরিসমাপ্তি ঘটবে। তিনি আরও বলেন, খুনি নূর চৌধুরী কানাডায় পলাতক রয়েছেন। আমি কানাডা সরকারকে বলেছি, বাংলাদেশে একটি মামলায় তার ফাঁসির আদেশ হয়েছে। কানাডা সরকারের আইন রয়েছে, মৃত্যুদ- কার্যকর করা হতে পারেÑ এমন কোনো পলাতক আসামিকে তারা ফেরত দেন না। একটি আবেদনের ভিত্তিতে নূর চৌধুরী সেখানে বসবাস করছেন।

তিনি কী আবেদন করেছেন এবং কী কারণে কানাডা সরকার তাকে সেখানে থাকতে দিয়েছে, সেসব কাগজপত্র চেয়ে কানাডা সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম; কিন্তু প্রাইভেসি অ্যাক্টের কারণে কানাডা সরকার সেসব কাগজপত্র দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তখন আমরা আইনজীবী নিয়োগ করে সে দেশের আদালতে আবেদন করি। সে দেশের আদালত বলেছেন, এসব কাগজপত্র দেওয়া যাবে। এখন আমরা সে অনুযায়ী অগ্রসর হচ্ছি।

মন্ত্রী বলেন, আরেক খুনি রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেছেন। সে ব্যাপারে আমরা এখন যে পরিস্থিতি সেটা অবজার্ভ করছি এবং এর অগ্রগতির ব্যাপারে আলোচনা করছি। আর বাকি তিন পলাতক আসামির অবস্থানের ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই। তাদের ব্যাপারে অনুসন্ধান চলছে। আমরা মনে করি, এ প্রচেষ্টায় আমরা এক দিন সাফল্য লাভ করব।

পালিয়ে থাকা অন্য তিন খুনির মধ্যে কয়েক বছর আগে খন্দকার আবদুর রশিদকে কখনো স্পেনে, শরিফুল হক ডালিমকে কখনো পাকিস্তানে ও মোসলেমউদ্দিনকে জার্মানিতে দেখা যাওয়ার বিষয়ে অসমর্থিত সূত্রে তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। জার্মানি, স্পেন ও পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ মিশন ২০১৭ সালের নভেম্বরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানায়, রশিদ, ডালিম ও মোসলেম ওই তিন দেশে অবস্থান করছেন না। ২০১১ সালে মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের আগ পর্যন্ত রশিদ নিয়মিতভাবেই লিবিয়ায় অবস্থান করতেন বলে বিভিন্ন সময় খবর বেরিয়েছে।

১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকার দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ১৫ জনকে মৃত্যুদ-াদেশ দেন। নিম্ন আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও মৃত্যুদ- নিশ্চিতকরণের শুনানি শেষে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট দ্বিধাবিভক্ত রায় দেন।

২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃত্যুদ- বহাল রেখে তিনজনকে খালাস দেন। ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়া পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করেন। ফলে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যার দায়ে হাইকোর্টের দেওয়া ১২ খুনির মৃত্যুদ-াদেশ বহাল থাকে।

২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মুহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। রায় কার্যকরের আগেই ২০০১ সালের জুনে জিম্বাবুয়েতে মারা যান আজিজ পাশা। আর এবছরে ১১ এপ্রিল দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এই খুনি দীর্ঘদিন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় পালিয়ে ছিলেন।

শেয়ার করুন »

মন্তব্য করুন »