চুল মানুষের সৌন্দর্যের অন্যতম আকর্ষণ। চুল পড়া যেকোনো বয়সের মানুষের কাছেই অস্বস্তিকর, তবে তরুণদের কাছে এটা এক বিরাট আতঙ্কের বিষয়। চুল পড়া বিশ্বজুড়ে কয়েক মিলিয়ন মানুষকে প্রভাবিত করছে ও তাদের উদ্বেগের কারণ হিসেবে পরিণত হয়েছে।
চুল পড়া ব্যথাহীন হলেও, প্রতিদিন চুল পড়া খুব মন খারাপ করে দেয়, এটি আমাদের সৌন্দর্যকে বাধা দেয় এবং সময়ের আগেই বৃদ্ধ দেখায়। সৌন্দর্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দিনে ১০০টি চুল হারানো স্বাভাবিক, তবে এর বেশি চুল পড়া শুরু হলে বুঝতে হবে চুলের যত্নের প্রয়োজন।
গ্রামের মহিলারা সাধারণত পুষ্টির অভাবে ভোগেন আর শহরের মেয়েরা ডায়েট কন্ট্রোলের চেষ্টা করেন। এগুলো চুল পড়ার কারণ। ফাস্ট ফুড, সফট্ ড্রিংকস খাওয়াও চুল পড়ার অন্যতম কারণ। চুলের ম্যাক্সিমামটা হলো প্রোটিন। চুল ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেড এবং পানি দিয়ে গঠিত।
প্রতিদিন শ্যাম্পু করলে চুল পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। শ্যাম্পু অ্যালকালিক বা ক্ষার দিয়ে তৈরি। ক্ষার এবং প্রোটিন একত্রিত হলে প্রোটিন ভেঙে যায়। এতে চুল ভেঙে পড়বে ও চুল পড়া শুরু হবে। চুল পড়া সমস্যার সমাধানে হারবাল উপাদানের ভূমিকা নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
আমলকীর প্যাক
চুল পড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে ভিটামিন সি’র অভাব। আমলকীতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে। আমলকী চুলপড়া বন্ধ, চুলের খুশকি দূর করে। আমলকীর রস হারবাল তেলের সঙ্গে মিশিয়ে চুলের গোড়ায় লাগালে উপকার পাওয়া যায়। যাদের চুলের গোড়া দুর্বল তাদের জন্য ব্রাহ্মী, আমলা, তিলের তেলের সংমিশ্রণে বানানো তেল সপ্তাহে তিন দিন ব্যবহার করতে পারেন।
আমলকী চুলের টনিক হিসেবে কাজ করে এবং চুলের পরিচর্যার ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্র্ণ উপাদান। এতে ভিটামিন, মিনারেল এবং খনিজের পুষ্টি উপাদান রয়েছে। এটি শুধু চুলের গোঁড়া মজবুত করে তা নয়, এটি চুলের বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে। আমলকী, ডিমের সাদা অংশ, হারবাল তেল এবং লেবুর রসের প্যাক নিয়মিত ব্যবহারের ফলে দ্রুত চুলের বৃদ্ধি হবে, আর্দ্রতা বজায় থাকবে, চুল হবে মসৃণ ও উজ্জ্বল। তা ছাড়া নিয়মিত আমলকী খেলে আমাদের শরীর ও চুলের জন্য খুবই উপকার হবে।
ব্রাহ্মীর প্যাক
চুলের বেশির ভাগ সমস্যা শুরু হয় স্ক্যাল্পের সমস্যা থেকে আর স্ক্যাল্পের সমস্যা সমাধানে ব্রাহ্মী অব্যর্থ ঔষধির কাজ করে। নতুন চুল গজানো থেকে শুরু করে অকালপক্বতা রোধসহ নানাভাবে ব্রাহ্মী উপকারে লাগে। চুলের ফলিকল বা গোড়া মজবুত করতে ব্রাহ্মী খুবই উপকারী।
তেলের মধ্যে ব্রাহ্মী ভিজিয়ে রেখে, সেই তেল দিয়ে চুলের গোড়ায় গোড়ায় মালিশ করলে চুলের গোড়া তো মজবুত হবেই এবং চুল পড়ার সমস্যাও দূর হবে। চুলের বৃদ্ধির জন্য দরকারী ভিটামিন সি আমলকীতে আছে। তাই ব্রাহ্মীর সঙ্গে আমলা ব্যবহার করা উত্তম। ব্রাহ্মীর সাথে ৩-৪টি আমলকি বেটে নিয়ে সামান্য পানি মিশিয়ে ব্রাহ্মী ও আমলকির হেয়ার প্যাকটি তৈরি করে নিন। ১৫-২০ মিনিট চুলে লাগিয়ে, শুকিয়ে গেলে শ্যাম্পু করে নিন। মাসে ৩-৪ বার ব্যাবহার করুন, ভালো ফল পাওয়া যাবে।
অ্যালোভেরার প্যাক
অ্যালোভেরাতে রয়েছে এমন কিছু এনজাইম, যা চুলের বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ফলে চুল পড়লেও মাথা ফাঁকা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে না। অ্যালোভেরাতে উপস্থিত অ্যালকালাইন প্রপার্টিজ স্ক্যাল্পের পি এইচ লেভেল ঠিক রাখতে সাহায্য করে। ফলে চুল পড়ার হার কমে। অ্যালোভেরা জেলের সাথে আমলকী, মেথি এবং ভেটিভার পেস্ট আকারে তৈরি করে হেয়ার প্যাক হিসেবে লাগাতে পারেন।
এতে করে ফাঙ্গাল ইনফেকশন কমবে, তেমনি খুশকির উপদ্রব কমে যাবে, চুল পড়া কমবে। তবে ময়েশ্চার লেভেল ঠিক রাখতে এর সাথে সামান্য তেল মিশিয়ে নিতে পারেন। অ্যালোভেরা, মেহেদি, আমলকী, মেথি সবগুলো উপাদান একসাথে বেটে কয়েক চামচ লেবুর রস মিশিয়ে ব্যবহার করুন। যাদের চুল একটু শুষ্ক ধরনের তারা আগে চুলে তেল লাগিয়ে নিন। স্ক্যাল্পের চুলকানি কমাতে ও চুল ঝরা রোধে সহায়তা করবে এই মিশ্রণ।
বাদামের প্যাক
স্বাস্থ্যের মতো চুলের জন্য কাঠবাদাম একটি উপকারী উপাদান। এতে থাকা ভিটামিন ই চুল পড়া কমিয়ে নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে। কাঠবাদামের তেলে থাকা ভিটামিন ই, ডি, পটাশিয়াম ম্যাগনেসিয়াম-এর অন্যতম উৎস যা চুলকে নরম ও উজ্জ্বল করতে সাহায্য করে।
কয়েক ফোঁটা ব্যবহারেই বেশ কাজ করে। চুল পড়া কমাতে ডিমের কুসুমের সঙ্গে ১ টেবিল চামচ কাঠবাদামের তেল ও ১ টেবিল-চামচ মধু ভালোভাবে মেশাতে হবে। তারপর মিশ্রণটি চুলের গোড়া ও পুরো চুলে লাগিয়ে গরম তোয়ালে দিয়ে পুরো মাথা পেঁচিয়ে এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। সবশেষে শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলতে হবে। মাথায় নতুন চুল গজাতে ও চুল পড়া কমাতে মিশ্রণটি সপ্তাহে একবার ব্যবহার করতে হবে।
নিয়মিত এই তেল মাথায় মালিশ করলে চুল হয় মসৃণ ও নরম। ফলে চুল সামলানো সহজ হয়। তাছাড়া কাঠবাদামের তেল মাথার ত্বকে রক্ত চলাচল ঠিক রেখে নতুন চুল গজাতে ও ভঙ্গুর চুল দ্রুত ঠিক করতে সাহায্য করে। মাথার ত্বকের ভিতর ঢুকে চুলের গভীর থেকে পুষ্টি যোগায় কাঠবাদামের তেল। ফলে চুল হয় নরম ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল।
লেবু, পেঁয়াজের রস ও ডিমের প্যাক
চুল পড়া রোধ করার একটি অন্যতম উপাদান হলো লেবু। লেবুতে ভিটামিন থাকায় তা অধিক মাত্রায় চুল পড়া কমাতে সাহায্য করে। লেবু সাইট্রিক এসিড, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ হওয়ায় চুলের খুশকি দূর করে চুলকে উজ্জ্বল রাখে এবং মাথার ত্বকে কোনো সমস্যা হলেও তার সমাধান করে। সপ্তাহে এক দিন পাতি লেবুর রস মাথার ত্বকে মেখে কিছুক্ষণ রেখে পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।
চুল পড়া রোধ করে চুলের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটাতে অন্যতম কার্যকর উপাদান হলো পেঁয়াজের রস। পেঁয়াজের রসে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টি-ফাঙ্গাল উপাদান থাকায় চুলে পুষ্টি যুগিয়ে চুলকে ঘন ও মজবুত করে তোলে। চুল উঠে যাওয়ার সমস্যায় ব্যবহার করতে পারেন ডিম।
এই উপাদানটি চুলের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটাতে সাহায্য করে। চুলকে মসৃণ করে তোলে। যাদের চুল তৈলাক্ত তারা ব্যবহার করবেন ডিমের সাদা অংশ এবং যাদের চুল শুষ্ক তারা ডিমের কুসুমের অংশটি ব্যবহার করতে পারে। ডিমের মধ্যে থাকে প্রোটিন যা চুলকে পুষ্টি জুগিয়ে সুস্থ এবং উজ্জ্বল করে তোলে। ডিমের কুসুম এবং লেবুর রসের মিশ্রণ মাথার স্ক্যাল্প থেকে চুলের ডগা পর্যন্ত লাগিয়ে ২০ মিনিট রেখে শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে নিতে হবে। এ ছাড়া ডিম, টক দই, কলা বা ডিম, মধু, হারবাল তেল দিয়েও বানানো যেতে পারে ডিমের প্যাক। এটি মাসে এক বা দুবার ব্যবহার করলে চুল পড়া কমবে এবং দ্রুত চুলের বৃদ্ধি ঘটবে।
প্রতিটি চুলের বিজ্ঞাপনে চুলের যত্নে ব্যবহার্য পণ্যগুলোকে খুব চটকদারভাবে উপস্থাপন করে এবং প্রতিশ্রুতি দেয় স্বাস্থ্যকর, সুন্দর, উজ্জ্বল ও মসৃণ চুলের। কিন্তু প্রতিশ্রুতি মতে তা খুব কমই গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়। এ ছাড়া যদি ভালো পণ্য ব্যবহারের চেষ্টাও করে তা পাওয়া অনেক কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল।
তাই এই হারবাল উপাদানগুলোর গুণাগুণ রয়েছে এমন ভালো মানের তেলের মাধ্যমেও নিয়মিত চুলের যত্ন নেওয়া সম্ভব। মাথার ত্বকের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী যাচাই করে সঠিক তেলটি বাছাই করে ব্যবহারের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত চুল পাওয়া সম্ভব। কোরিয়ান আরমাললা ও অরগানমিন্ডস, শ্রীলঙ্কান কুমারিকা, যুক্তরাজ্যের হারবাল এসেন্স, চীনের মেলাও-এর পণ্যগুলো বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। তাদের হারবাল উপাদানের তৈরি পণ্যের ব্যবহার দিন দিন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তা ছাড়া চুলকে আকর্ষণীয় এবং স্টাইলিশ করার জন্য অনেকেই বিভিন্ন ধরনের রং করে থাকেন চুলে, কিছুদিন পর পর সেই রং পরিবর্তনের ফলে কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট চুল দ্রুত সাদা করে দেয় এবং চুল দ্রুত পড়তে থাকে। তাই চুলকে ভালো রাখতে বন্ধ করতে হবে ঘন ঘন রং করা।
পরিমাণ মতো পানি পান করলে শরীর সুস্থ থাকবে, পাশাপাশি সুস্থ থাকবে চুলও। পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করলে শরীর থেকে টক্সিন বেরিয়ে শরীর দূষণমুক্ত থাকে। কিন্তু সঠিক পরিমাণে পানি পান না করায় টক্সিন শরীরের ভিতর জমে যায় এবং মাথায় রক্ত সঞ্চালন কমে যায়। ফলে চুল পড়া বৃদ্ধি পায়। তাই দিনে কমপক্ষে ২.৫-৩.৫ লিটার পানি পান করা উচিত। চুলের যত্ন নিতে পর্যাপ্ত পানির পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমেরও প্রয়োজন। অনেকেই কাজের চাপে রাতে দেরিতে ঘুমিয়ে খুব সকালেই উঠে পড়েন। তাদের চুল পড়ার সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি।
প্রত্যেক মানুষই চুলের প্রতি সচেতন, সকলেই চান চুল ঘন এবং মজবুত হোক, কিন্তু যাদের চুল অঝোরো পড়তে গিয়ে টাক দেখা দেয় তাদের চুল পড়ার সমস্যার হাত থেকে বাঁচতে এই সকল হারবাল উপাদানের তৈরি প্যাক ব্যবহার অথবা এসব হারবাল উপাদান সমৃদ্ধ তেল ব্যবহার করা ও জীবনযাপনের নিয়মগুলো মেনে চলা আবশ্যক।