কুয়েতে গ্রেপ্তার লক্ষ্মীপুরের এমপি কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলের নির্দেশে তার লোকজন বাংলাদেশ থেকে নেওয়া কর্মীদের ওপর শোষণ ও নিপীড়ন চালাতেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে ভয়ভীতি দেখানো হতো। পাপুলের কর্মীরা বলতেন, ‘বেশি কথা বললে তোমরা কুয়েত থেকে দেশে যেতে পারবে না। মাইরা প্যাকেট কইরা মরুভূমিতে ফেলে দেব।’ আবার কাউকে বলা হতো, ‘কথা বললে সোজা দেশে পাঠিয়ে দেব।’ প্রতারিত হয়ে কুয়েত থেকে ফেরত আসা বাংলাদেশি শ্রমিকরা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুয়েতে লোভনীয় চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন পাপুল। অনেকে ভিটেমাটি বিক্রি করে নতুন জীবনের আশায় কুয়েত গিয়েছিলেন। প্রতারিত হয়ে তাদের অনেকে নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন।
কুয়েতফেরত কর্মীরা জানান, সেখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মার্কেটে টানা ১১ ঘণ্টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে নিরাপত্তা প্রহরীর ডিউটি করতে হতো তাদের। অথচ টেকনিশিয়ান, হেলপার ও ক্লিনারের চাকরি দেওয়ার কথা বলে তাদের নেওয়া হয়েছিল।প্রতারণার শিকার হয়ে ফেরত আসা দু’জন সমকালকে বলেন, অমানবিক পরিশ্রম করে তারা কাজ করতেন।
মাস শেষে বেতনের টাকা চলে যেত পাপুলের কোম্পানি মারাফি কুয়েতিয়ার ব্যাংক হিসাবে। ওইসব কোম্পানি থেকে মারাফি মাসে পেত ৩০০-৩৫০ দিনার। অথচ তাদের দেওয়া হতো ১০০-১২০ দিনার। এভাবেই শোষণ করে দেশে-বিদেশে নিজের বিক্ত-বৈভব গড়ে তুলেছেন পাপুল।
চলতি মাসের শুরুতে কুয়েতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মানব পাচার ও অর্থ পাচারের দায়ে পাপুলকে গ্রেপ্তার করে। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ থেকে ২০ হাজারের বেশি কর্মী কুয়েতে নিয়েছে পাপুলের প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে তিনি কুয়েতের কারাগারে আছেন। বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পাপুলসহ তার পোষ্যদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের একটি অভিযোগ অনুসন্ধান করছে।
‘মরুভূমির বালু খাও’ : কুমিল্লার হোমনার কাওসার আহমেদ সমকালকে বলেন, এমপি পাপুলের কোম্পানি ২০১৫ সালের শেষ দিকে তাকে কুয়েতে নেয়। কুয়েত বিমানবন্দরে নামার পরই তার লোকরা তাদের মরুভূমির ভেতরে একটি ক্যাম্পে রাখে। এরপর শুরু হয় নির্যাতন।
তিনি বলেন, ‘কুয়েত যাওয়ার পর সব কোম্পানিই শ্রমিকদের প্রথমে কিছুদিন চলার জন্য ২০-৩০ দিনার করে দিয়ে থাকে। তবে মারাফিয়া আমাদের কোনো অর্থ দেয়নি। আমরা বলেছিলাম, আমাদের হাত শূন্য। আপনারা টাকা না দিলে আমরা চলব কীভাবে? জবাবে মারাফির এক কর্মী বলেছিলেন, টাকা-পয়সা না থাকলে মরুভূমির বালু খাও।’
কাওসার জানান, তাকে হেলপার বা ক্লিনারের কাজ দেওয়ার কথা বলে নেওয়া হলেও ট্রাকে মালামাল খালাসের কাজ দেয়। টানা ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। সারাদিনে কোনো খাবার দেওয়া হতো না। এটা করতে অপারগতা প্রকাশ করলেও তাকে এ কাজে বাধ্য করা হয়। তিন মাস পেরিয়ে গেলেও আকামা (ওয়ার্ক পারমিট) দেওয়া হয়নি। আকামা চাইলে ধৈর্য ধরতে বলা হতো। চার মাসের মাথায় আরও এক মাস কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়। ওই এক মাস পর আকামা চাওয়া হলে বলা হয়, ‘তোমাদের কোনো কোম্পানি নেই। তোমরা বেওয়ারিশ।’
কাওসার বলেন, ন্যায়বিচারের জন্য কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। পাপুল দূতাবাসকেও ম্যানেজ করে রেখেছেন। এরপর আমাদের গ্রুপ ফোর কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। তারাও আমাদের আকামা দেয়নি। পরে আদালত দৌড়াইছি। কোনো কাজ হয়নি। শেষে বলতে গেলে শূন্যহাতেই বাড়ি ফিরতে হয়েছে। ‘ এক প্রশ্নেম্নর জবাবে কাওসার বলেন, কুয়েতে যেতে তাদের ৬ লাখ ৩৫ হাজার থেকে ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়েছে।
‘বেঁচে থাকলে ডিউটিতে যেতেই হবে’ : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের শেখ ফরিদ বাবুও কুয়েত গিয়েছিলেন পাপুলের মাধ্যমে। এটা ১৯৯১ সালের দিকের কথা। তিনিও করুণ অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা কয়েকজন তখন অনার্সে পড়াশোনা করতাম। টেকনিশিয়ান, হেলপার হিসেবে চাকরির লোভ দেখানো হয়েছিল আমাদের। আয়ের ভালো উপায় ভেবে লেখাপড়া ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। কুয়েতে যাওয়ার পর আমাদের কোনো কাজ দেওয়া হয়নি। হাতে টাকা-পয়সাও নেই। খাবার না পেয়ে উপোস থাকতে হয়েছে। নিরূপায় হয়ে পাশের একটি ক্যাম্পে গিয়ে ধারদেনা করে কিছু টাকা জোগাড় করে কিছুদিন চলেছি। পরে আমাদের বলা হলো, ১২ ঘণ্টা ডিউটি করলে ৯০ দিনার আর ৮ ঘণ্টা ডিউটি করলে ৬০ দিনার দেওয়া হবে। এরপর আমাদের নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ দেওয়া হয়।’
ফরিদ বাবু বলেন, ‘১২ ঘণ্টার ডিউটির মধ্যে ১১ ঘণ্টাই দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। এটা আমাদের জন্য খুবই কষ্টের ছিল। অনেকে কান্নাকাটি করেছে। তবু মাফ নেই ডিউটি করতেই হবে। কেউ ডিউটিতে যেতে না চাইলে তাকে পিটিয়ে পাঠানো হতো। কোনো ছুটি ছিল না। বেঁচে থাকলে ডিউটিতে যেতেই হবে- এটা ছিল মারাফিয়ার নির্দেশ।’
তিনি বলেন, ‘যাওয়ার পর তিন মাস পেরিয়ে গেলেও আমাদের আকামা দেওয়া হয়নি। আমরা আকামার জন্য জোরাজুরি শুরু করলে পাপুলের লোকজন আমাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে বলেছেন, এভাবে কথা বললে তোমরা কুয়েত থেকে দেশে যেতে পারবে না। মাইরা প্যাকেট করে মরুভূমিতে ফেলে দিয়ে আসব। আবার কাউকে বলতেন, সোজা বাড়িতে পাঠিয়ে দেব।’ তিনি বলেন, ‘কুয়েতে যতদিন ছিলাম অবৈধ শ্রমিক হিসেবে থাকতে হয়েছে। পাপুলের কোম্পানির শোষণের জাঁতাকলে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। কী অপরাধ ছিল আমাদের?’ সমকাল