বিখ্যাত ফিল্ম সিরিজ ‘লর্ড অব দ্যা রিংস’ এ এমন কিছু গাছ দেখানো হয়েছিলো যা নড়াচড়া করতে ও কথা বলতে পারে। সিনেমার ফ্যান্টাসির জগতে তো কতকিছুই ঘটে, জড় বস্তুও কথা বলতে বা চলাফেরা করতে পারে। কিন্তু জানার বিষয় হচ্ছে বাস্তবে কি এমন গাছ আদৌ আছে কীনা!
আমরা জানি, পৃথিবীর সকল জীবকেই দুটি প্রধানভাগে ভাগ করে ফেলা যায়। প্রাণী ও উদ্ভিদ। প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে প্রাণী নড়াচড়া করতে পারে, উদ্ভিদ পারেনা। কিন্তু জগতে সবকিছু যেমন উপপাদ্য দিয়ে বিচার করা চলেনা, প্রয়োজনে অনুসিদ্ধান্তেও আসতে হয়; তেমনি রহস্যময় এ পৃথিবীর বৈচিত্র্য রক্ষার প্রয়োজনেও কিছু আশ্চর্যজনক ব্যতিক্রম ঘটে। আজকে সেরকমই একটি ব্যতিক্রমী জাগতিক রহস্যের গল্প শোনাতে এসেছি।
হেঁটে বেড়ানো গাছের গল্প!
পৃথিবীর ক্রান্তীয় বৃষ্টিপাত বা রেইনফরেস্ট অঞ্চলগুলোর কিছু কিছু উদ্ভিদ, লতাপাতা ও বৃক্ষ কিন্তু সত্যি সত্যিই কিছুটা স্থান পরিবর্তন বা চলাচল করতে পারে, যা কিনা মোটেই বৃক্ষসুলভ বা উদ্ভিদসুলভ আচরণ নয়! তাই প্রশ্ন আসাটা খুবই স্বাভাবিক, কেন এরকম হয়?
স্থান পরিবর্তনে সক্ষম বা চলাফেরায় সক্ষম এমন গাছের কথা বলতে গেলে, প্রথমেই আসে মধ্য আমেরিকার দেশ কোস্টারিকার কথা। কোস্টারিকার গহীন রেইনফরেস্ট অঞ্চলে যেসকল পর্যটক বেড়াতে যান, তাদের সকলেই কখনো না কখনো ট্যুর গাইডদের কাছে হাঁটাচলা করতে পারা অদ্ভুত একধরনের পাম গাছের কথা শুনেছেন, যার আঞ্চলিক নাম ‘ক্যাসাফোনা’(Cashapona) এবং বৈজ্ঞানিক নাম ‘Socratea exorrhiza.’ এটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৫০ থেকে ৮০ ফুট (১৫-২৫ মিটার) পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
আমাজন জঙ্গল ঘেরা মধ্য আমেরিকার আরেকটি দেশ স্লোভাকিয়ার বনগুলোতেও প্রচুর পরিমাণে দেখা মিলে এই হেঁটে বেড়ানো পাম গাছের।
২০১৫ সালে বিবিসির ট্রাভেল ব্লগে অভিযাত্রী কার্ল গ্রুবার লিখেছেন,
“চলন্ত বৃক্ষের সন্ধানে ইকুয়েডরের রাজধানী থেকে ‘সুমাকো বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ’ এর কেন্দ্রে প্রায় প্রায় ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে গিয়েছি, যেখানে যেতে পুরো একটা দিন সময় লাগে।
গাড়িতে করে বনের প্রান্তে ৩ ঘন্টা এবং তারপরে আরো গহীনে পৌঁছানোর জন্য নৌকা, খচ্চর এবং পায়ে হেঁটে প্রায় ১৫ ঘন্টা চলার পর সেই জায়গায় যেতে হয়। তবে যাওয়ার পর মনে হবে আপনার চেষ্টাটি সার্থক। কারণ, এই গাছগুলো অরন্যজুড়ে সরে যেতে থাকে এবং প্রায়ই এগুলোর নতুন নতুন শিকড়ের সৃষ্টি ও বৃদ্ধি ঘটে যা প্রতিদিন দুই বা তিন সেন্টিমিটার করে সরে যেতে থাকে।”
২০০৭ সালে প্রকাশিত একটি গবেষনায় উঠে এসেছে বিচিত্র এই পাম গাছগুলোর ক্রমাগত অবস্থান পরিবর্তনের কারণ। অতিরিক্ত জলাবদ্ধতা, দুর্বল ও অস্থায়ী মাটির জন্যই নাকি গাছগুলোর এই বিচিত্র অভিযোজন হয়েছে। দৈর্ঘ্যে অনেক লম্বা হলেও গাছগুলোর কান্ড ততটা বড় বা শিকড় অনেক বিস্তৃত নয়। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে গাছগুলো অভিযোজনের মাধ্যমে কান্ডের ঠিক নিচের অংশ থেকে প্রায় ২৫ টি শিকড়ের জন্ম দেয়। এবং ছোট অবস্থায় সেগুলো মাটি স্পর্শ না করে বাতাসেই অবাধে বড় হতে থাকে।
হেঁটে চলা গাছের অস্তিত্ত্ব নিয়ে গবেষণার পরিমাণ এখনো পর্যন্ত পাওয়া গেছে হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি। তাই এর অস্তিত্ত্বে বিশ্বাস করেনা, এমন বিজ্ঞানীও অনেক। এখনো এই বিষয়টা গবেষনাধীন। তাই, আরো কেউ বা কিছু গবেষক যদি জীবনের ঝুকি নিয়ে আমাজনের সেই গহীন অরণ্যে হেঁটে বেড়ানো বৃক্ষ নিয়ে নিবিড় গবেষনা ও পর্যবেক্ষন করেন , তাহলে হয়তো কোন একসময় বের হয়ে আসতে পারে এই গাছগুলোর প্রকৃত জীবন রহস্য, হেঁটে বেড়ানোর সত্যতা ও আসল কারণ।
লেখক- সুমাইয়া কিবরিয়া পিএইচডি গবেষক, এনিম্যাল রিসোর্স সায়েন্স, ডানকুক ইউনিভার্সিটি, সাউথ কোরিয়া।