‘রোমানিয়া’ — হয়তো বা এ দেশটি আমাদের দেশের মানুষের কাছে খুব বেশি একটা পরিচিত কোনও নাম নয়, আবার পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে যাঁরা বসবাস করেন যেমন : জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, স্পেন তাঁদের অনেকেই এ দেশটির নাম শুনলে আঁতকে উঠবেন। দেশটি ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত। এটির আয়তন ৯২ হাজার ৪৬ বর্গমাইলের মতো। রোমানিয়ার উত্তরে ইউক্রেন, দক্ষিণে বুলগেরিয়া, পূর্বে মলদোভা, পশ্চিমে হাঙ্গেরি, দক্ষিণ-পশ্চিমে সার্বিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব বরাবর প্রায় ২২০ কিলোমিটার সীমানাজুড়ে কৃষ্ণসাগরের উপকূল রয়েছে।
তবে যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে আমার জন্মভূমি বাংলাদেশের পর কোন্ দেশটিকে আমি সবার আগে পছন্দ করবো; আমি নিঃসন্দেহে সবার আগে কোনও ধরণের চিন্তা-ভাবনা না করেই সরাসরি রোমানিয়ার নাম বলবো। এ দেশের ভাষা-সংস্কৃতি এবং এখানকার মানুষের আন্তরিকতা ও ভালোবাসা আমাকে এতোটাই মুগ্ধ করেছে যে কোনও জানি বারবার আমার রোমানিয়াতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। এ দেশটি সত্যিকার অর্থে আমার কাছে ভালোবাসার অপর একটি নাম।
রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টকে পূর্ব ইউরোপের প্যারিস বলা হয়, বিভিন্ন কারণে রোমানিয়া ভ্রমণের এ স্মৃতি আমার অন্তরে সব সময় অম্লান। যান্ত্রিকতায় পরিপূর্ণ ইউরোপে আজকের এ যুগেও যে মানুষ এতো আন্তরিক হতে পারে সেটা রোমানিয়া না গেলে বিশ্বাসই করতাম না। আর সম্পূর্ণ রোমানিয়া ভ্রমণে যতোগুলো মহৎ হৃদয়ের মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছি তাঁদের মধ্য থেকে এ বিশেষ একজনের কথা স্বীকার না করলে হয় তো বা অনেক বড় একটি পাপ হয়ে যাবে।
‘আলিনা ক্রিস্টিনা উদরেস্কু!’
যদি কেউ আমাকে বলে থাকেন যে আমার জীবনের কতোগুলো বিশেষ প্রাপ্তি যেগুলো উল্লেখ না করলেই নয় তাহলে আমি নিঃসন্দেহে এ নামটি সবার উপরের দিকে রাখবো।
আসলে আমার এ রোমানিয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে সাত রঙে সম্পূর্ণভাবে রাঙাতে পেরেছি এ আলিনা ক্রিস্টিনা উদরেস্কু এর কারণে। আলিনা ক্রিস্টিনা উদরেস্কুর সাথে আমার পরিচয় হয় ২০১৪ সালে, তখন আমি কেবল ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। যদিও আমি ফেসবুক ব্যবহার করি ২০১০ সাল থেকে কিন্তু মোটামুটি আজকের মতো এ রকম নিয়মিতভাবে ফেসবুক ব্যবহার শুরু করি সে বছরই।
সে সময় আমার মোটর স্পোর্টসের প্রতি আলাদা আগ্রহ ছিলো, বিভিন্ন ফেসবুক পেইজে গিয়ে সে সময় বিভিন্ন স্পোর্টস বাইকারদের ছবি খুঁজে বের করে তাঁদেরকে ম্যাসেজ করাটা কেনও জানি আমার একটি অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। এভাবে হঠাৎ করে একদিন কোনও এক ফেসবুক পেইজে যেতে না যেতেই ক্রিস্টিনার ছবি আমার চোখে ভেসে আসে এবং ছবির নীচে তাঁর নাম লিখা ছিলো। আমি তখন ফেসবুকে তাঁর নাম লিখে সার্চ করলাম এবং তাঁর ফেসবুক আইডি খুঁজে পেলাম। এরপর আমি তাঁকে একটি ম্যাসেজ করলাম আমার পরিচয় দিয়ে এবং আমি বললাম যে আমি তাঁর সাথে যোগাযোগ স্থাপনে আগ্রহী। কিছুক্ষণ পর দেখলাম ক্রিস্টিনা আমাকে ম্যাসেজ করলো এবং আমাকে বললো তাঁকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠানোর জন্য, এরপর আমি তাঁকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠালাম এবং সে আমাকে তাঁর ফেসবুক ফ্রেন্ড হিসেবে গ্রহণও করলো। এরপর আমাকে সে প্রশ্ন করলো, “Are you happy to be my friend?” আমি তাঁকে উত্তর দিলাম, “Why not? It’s one my pleasures that I have been able to become a friend of yours”. তারপর তাঁকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করলাম বিশেষ করে মোটর স্পোর্স এবং এখানে কীভাবে সে এলো কিংবা তাঁর বিভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে অনেক আলোচনা হলো। এভাবেই ক্রিস্টিনার সাথে আমার পরিচয়।
ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর ইউনিভার্সিটির ভর্তি কোচিং, বাহিরে যাওয়ার প্রস্তুতি সব মিলিয়ে আসলে এতোটা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম এবং সেই সাথে আসলে বেশ কিছু পারিপার্শ্বিকতার কারণে কেনও জানি এ আগ্রহটি আবার আমার মধ্য থেকে হারিয়ে গিয়েছিলো এবং একটা দীর্ঘ সময় প্রায় আড়াই বছর এরপর আর ক্রিস্টিনার সাথে কখনও যোগাযোগ হয় নি সেভাবে।
২০১৮ সালের মার্চের শেষ এবং এপ্রিল মাসের শুরু এমন সময় ক্যাথলিক চার্চগুলোতে বিশ্বাসী মানুষেরা ইস্টার উৎসবে মেতে উঠে এবং বলা হয়ে থাকে যে বড় দিন বা খ্রিস্টমাসের পর ক্যাথলিক চার্চে বিশ্বাসী মানুষদের কাছে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে “ইস্টার”। ইস্টারের ছুটিতে বেড়িয়ে পড়লাম বুলগেরিয়া এবং রোমানিয়া ঘুরতে, বলাবাহুল্য ইউরোপ আসার পর এটি ছিলো আমার প্রথম কোনও ট্রিপ নিজের থেকে। জীবনে অনেক বসন্ত এসেছে কিন্তু কেনও জানি এ “রোমানিয়া” এবং “ক্রিস্টিনা” এ দুইটি শব্দের কথা স্মৃতিপটে ভেসে আসলে মনে হয় যে জীবনের শ্রেষ্ঠ বসন্তটি ঐ সময়ই বুঝি ফেলে চলে এসেছি। এদিনটিতে সত্যিকার অর্থে আমি হেসেছিলাম, আবার এ দিনটি আমাকে কাঁদিয়েছিলো শেষ বিকেলে সব কিছু শূণ্য করে।
বুখারেস্টে ঘুরার জন্য যখন পরিকল্পনা করি তখনই ম্যাসেজ দিই হঠাৎ করেই ক্রিস্টিনাকে, ফেসবুকের ভার্চুয়াল জগৎ থেকে বের করে এবার সত্যি সত্যি সামনাসামনি তাঁকে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করি।
ক্রিস্টিনার বাসা ছিলো আলেকজান্দ্রু আইওয়ান কুজা পার্কের কাছে। বুখারেস্টের সিটি সেন্টার থেকে বেশ খানিকটা দূরে এবং সম্পূর্ণ কোলাহল ও নির্জঞ্ঝাটমুক্ত একটি জায়গা। ট্রাফিক জ্যাম বুখারেস্টে বসবাস করা সাধারণ মানুষদের কাছে নিত্যদিনের প্রধান সমস্যা, আসলে বুখারেস্টের স্থানীয় প্রশাসন যানবাহনের ওপর অনেক ভর্তুকি প্রদান করে এবং এ কারণে শহরের বেশীর ভাগ জায়গাতেই সে অর্থে গাড়ি পার্কিং করতে তেমন খরচ হয় না আর এ কারণে সবাই যে যাঁর মতো পারে যেখানে সেখানে গাড়ি পার্ক করে রাখে যা শহরটিতে যানজট সৃষ্টির প্রধান একটি কারণ। সেই সাথে গাড়ির হর্নের শব্দ তো আছেই। কিন্তু এ জায়গাটি পুরোপুরি নীরব এবং শান্তিতে মনের আনন্দে নিঃশ্বাস নেওয়ার একটি আদর্শ জায়গা বলা চলে। ক্রিস্টিনা আমাকে আলেকজান্দ্রু আইওয়ান কুজা পার্কে আসার জন্য বললো। আমাকে দেখার সাথে সাথে ক্রিস্টিনা আমাকে জড়িয়ে ধরলো এবং আমার গালে একটা চুমু আঁকলো। সে এক অনাবিল প্রশান্তি!!! পৃথিবীতে এর থেকে প্রশান্তির খুব কম জিনিসই আছে। আমরা বেশ কিছু ক্ষণ একসাথে পার্কের ভেতর হাঁটাহাঁটি করলাম, ক্রিস্টিনা আসলে সম্পূর্ণ বিপরীত জগতের একজন মানুষ। তবে তাঁর মধ্যে সৃষ্টিশীল ব্যক্তিসত্ত্বা রয়েছে যা সত্যি আমাকে মুগ্ধ করেছে। ক্রিস্টিনা প্রকৃতির বিভিন্ন ছবি তুলতে ভীষণ ভালোবাসে। কখনও গাছ কিংবা গাছের পাতা, ঘাস, পাখি, কাঠবিড়ালী এ সবের ছবি তোলে।কিছুক্ষণ পার্কে বসে গল্প করার পর আমরা চলে গেলাম পার্কের ঠিক বিপরীতে থাকা একটি শপিং মলে। শপিং মলের ছাদে চিলেকোঠায় একটা রেস্টুরেন্ট ও কফি বার রয়েছে। সেখান থেকে পুরো পার্কের অসাধরণ একটি ভিউ পাওয়া যায়। আমি সারাদিন ঘুরাঘুরি কারণে বেশ তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েছিলাম, এজন্য আমি কোকা কোলা অর্ডার করলাম আর ক্রিস্টিনা কফি অর্ডার করলো। এরপর অনেক ক্ষণ একসাথে গল্প হলো, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হলো।
ক্রিস্টিনার বর্তমান বয়স প্রায় বত্রিশ যেখানে আমার বয়স মাত্র বাইশ। আমার থেকেও দশ বছরের বড় কিন্তু তারপরেও কেনও জানি যখন ক্রিস্টিনার কথা মনে পড়ে তখন আমার মনের থেকে অন্য রকম কিছু একটা উপলব্ধি হয়। কোনও এক অজানা কারণে আমি দূর্বল হয়ে পড়ি। ২০১৮ সালে আমার আবিষ্কার করা সবচেয়ে সুন্দর জিনিসটি ছিলো এ ক্রিস্টিনা। ২০১৪ সালে যাঁর সাথে আমার ফেসবুকে পরিচয় হয়েছিলও। কখনও ভাবি নি যে সামনাসামনি এভাবে দেখা করতে পারবো কিংবা ফেসবুকে ভার্চুয়ালি পরিচয় হওয়া কোনও একজন মানুষও যে এতোটা সুন্দর হতে পারে সেটা কখনও কল্পনায় ছিলো না। জীবনের অন্যতম সেরা একটা অভিজ্ঞতা পেয়েছি আমি এ ক্রিস্টিনার থেকে। এক সাথে সে কফি বারে কিছু সময় অতিবাহিত করার পর আমরা আবার কিছুক্ষণ একসাথে আবারও পার্কে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করি।
ক্রিস্টিনা আমাদের সবার থেকে আলাদা, সে চায় জীবনটাকে উপভোগ করতে। নিজের ইচ্ছাশক্তির ওপর বেঁচে থাকতে, সমাজের সকল প্রথাকে সে ভাঙতে চায়। আমরা আজকে অনেকেই ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর একটা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য ডুকরে কেঁদে পরে আর সেই ইউনিভার্সিটিকে সে প্রত্যাখ্যান করে চলে আসে এই বলে যে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জনের থেকে বাস্তবিকভাবে কোনও জ্ঞান অর্জন এবং সেই সাথে নিজের অর্জিত অভিজ্ঞতাকে সমাজের মানুষের কল্যাণে ব্যয় করাটাই প্রকৃত স্বার্থকতা। কর্পোরেটক্রেসিকে সে পুরোপুরি ভেঙ্গে দিতে চায়। আমাদের সকলের চিন্তার বাহিরে গিয়েও সে নিজেকে মেলে ধরতে চায়।
এক সাথে কিছু ছবি তুলি, ততোক্ষণে বিকেল হয়ে গিয়েছে আর আমার ফেরার সময়ও হয়ে গিয়েছে। ফিরে যাওয়ার বাসার ছাড়ার সময়ও হয়ে এসেছে। ক্রিস্টিনা আমাকে মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। সেখানে দায়িত্বেতে থাকা এক পুলিশ সদস্যকে আমরা অনুরোধ করি আমাদের আরও কিছু ছবি তুলে দেওয়ার জন্য। তিনি দায়িত্ব -অবস্থায়ও আমাদের অনুরোধ রাখেন আন্তরিকতার সাথে। এরপর আমি ক্রিস্টিনাকে বিদায় জানিয়ে মেট্রোতে উঠে পড়ি সে মিলিটারি অটোগারার উদ্দেশ্যে যেখান থেকে আমার বাস ছাড়ার কথা ছিলো। বিদায় লগ্নে ক্রিস্টিনা আমাকে আরও দুইবার জড়িয়ে ধরেছিলো এবং আমার গালে চুমু এঁকেছিলো। সে এমন এক স্বাদ যে স্বাদ পৃথিবীর সমস্ত ঝালকে কিংবা তেতোকে এক নিমেষে পৃথিবীর সবচেয়ে সুমিষ্ট কোনও বস্তুতে পরিণত করতে পারে।
এরপর? এরপর আবার সেই আগের জীবন। সেই ভার্সিটি, পড়াশুনা, ব্যক্তিগত বিভিন্ন চাপ তবে ক্রিস্টিনার সাথে সেইদিনের সে মুহূর্তগুলো সব সময়ই আমার হৃদয়ে চির ভাস্কর। জানি না সে ভালো লাগা আদৌতে কোনও ভালোবাসায় পরিণত হলো কি না তবে জানি যদি সেটা ভালোবাসায় পরিণত হয়ও কোনও দিন্ সেটাকে বাস্তবায়িত করাও সম্ভব নয় কেননা আমাদের সমাজে এ ধরণের অসম প্রেম কাহিনীগুলো কখনও স্বার্থকতা লাভ করে না। আমি জানি না কেনও তবে ছোটো বেলা থেকেই আমি দেখেছি আমাদের দাদা-দাদী কিংবা নানা-নানী এমনকি আমাদের বাবা-মার সময়ের মানুষেরাও যখন বাড়িতে কোনও ছেলের জন্য পাত্রী অনুসন্ধানে বের হতো সব সময় চেষ্টা করে এমন কাউকে খুঁজে বের করতে যাঁর বয়স কি না পাত্রের বয়সের তুলনায় অন্ততঃ পাঁচ বছরের নীচে। আমাদের সমাজে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরণের ভালোবাসা আসলে শেষ পর্যন্ত অসমাপ্ত থেকে যায়, অন্তত আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজে কোনও বাবা-মাই মেনে নিবে না যে তাঁর ছেলে এমন কাউকে বিয়ে করুক যিনি কি না তাঁর ছেলের তুলনায় বয়সে বড়।
এখনও মাঝে মধ্যে ফেসবুকে যোগাযোগ হয় ক্রিস্টিনার সাথে, আসলে এখন ক্রিস্টিনার সময়টা খুব ভালো যাচ্ছে না। বছর দুইয়েক আগে তাঁর বাবাও মারা যায় এবং তাঁর মা এখন বয়সে অনেকটা বৃদ্ধ। এক ধরণের টানা-পোড়নের মধ্য দিয়ে সে যাচ্ছে। মোটর স্পোর্টস নিঃসন্দেহে অনেক ব্যয়বহুল, তাই নিয়মিতভাবে মোটর স্পোর্টসে সে অংশ নিতে পারছেও না। এদিকে তার বয়স ত্রিশ পেরিয়ে গিয়েছে, এখনও যদিও সে যথেষ্ট ফিট কিন্তু তবুও কেনও জানি সে স্পন্সর পাচ্ছে না যার মাধ্যমে সে আসলে আবার কাঙ্খিতভাবে রেসিং ট্র্যাকে ফিরে আসবে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার ওপর সে খুবই ক্ষুব্ধ কেননা তাঁর বক্তব্য হচ্ছে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা এমন একটি অর্থনৈতিক সিস্টেমের জন্ম দেয় যেখানে মানুষের কোনও স্বপ্ন থেকে আরম্ভ করে নিত্য প্রয়োজনীয় মৌলিক অধিকার এমনকি চিকিৎসা সেবার মতো মানবিক বিষয়গুলোও বাণিজ্যের একটি বিষয় হিসেবে পরিণত হয়। নতুন করে মোটর বাইক কেনা এমনকি তাঁর এখন যে বাইকটি রয়েছে বেশ পুরোনো বাইক সেটাতে চাকার মেরামত করতে যে খরচটুকু প্রয়োজন সেটিও তাঁর হাতে নেই। আবার রোমানিয়া যদিও বর্তমানে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কিন্তু তারপরেও এখনও দেশটির সাধারণ মানুষের আয় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্যান্য দেশ থেকে অনেক নীচে।
মানুষ বাঁচে আশায়, ক্রিস্টিনা এখনও স্বপ্ন দেখে যে তাঁর এ দুরাবস্থা কোনও একদিন দূর হবে এবং সে আবারও মোটর স্পোর্টসে তাঁর হারানো অর্জনকে ফিরিয়ে আনবে।
অপুর জীবনে কোনও দিন্ আর হৈমন্তি ফিরে এসেছি কি না এটা জানা না গেলেও আমার এরপর আর কোনও দিন্ ক্রিস্টিনার সাথে দেখা হয় নি। তবে ক্রিস্টিনা আমার অবচেতন মনে হয় তো বা ক্ষণিকের এক হৈমন্তি যাঁর হাসিটুকু আমি সব সময় খুঁজে বেড়াই। জানি না আর কোনও দিন্ দেখাও হবে কি না ক্রিস্টিনার সাথে তবে যদি কোনও দিন্ একটা টাইম মেশিন বানাতে পারি আমি চেষ্টা করবো বসন্তের সেদিনের সে বিকেলে আবার হারিয়ে যেতে। ক্রিস্টিনার সাথে করে আমি পুরো পৃথিবী দেখতে চাই, তাকে জড়িয়ে ধরে আবারও তাঁর গালে চুমু আঁকতে চাই।
বেশ কয়েক বছর আগে একটি সিনেমা দেখেছিলাম, এটি ছিলো একটি ইতালিয়ান সিনেমা। এ সিনেমার কাহিনী এতোটাই অসাধারণ ছিলো যে পরবর্তীতে সেরা বিদেশি ভাষার সিনেমা হিসেবে এটি অস্কার পুরস্কারের সম্মাননা অর্জন করেছিলো, সিনেমার নাম “মালেনা”। মূলতঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালির সিসিলিতে বারো বছরের এক কিশোর রেনাতোর সাথে তার এক শিক্ষিকা যাঁর নাম ছিলো মালেনা (যিনি মূলত : এ সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র); মালেনার প্রতি তাঁর দুর্বলতা এবং ভালো লাগার কাহিনী নিয়ে। নিঃসন্দেহে এটি ছিলো একটি অসম প্রেম কাহিনী কেননা রেনাতোর সাথে মালেনার বয়সের পার্থক্য ছিলো অনেক বেশী এবং মালেনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর স্বামীকেও হারিয়েছিলো।
কাছে আসার সব গল্পই পূর্ণতা পায় না। সিনেমার শেষ অংশে এসে দেখা যায় যে রেনাতো এখন প্রায় বৃদ্ধ এবং শেষ বয়সে এসেও তাঁর উপলব্ধি যে তিনি তাঁর জীবনে অনেক নারীকে ভালোবেসেছেন কিন্তু মালেনা একমাত্র নারী যাঁকে তিনি কোনও দিনই ভুলতে পারবেন না। ক্রিস্টিনাকে ভালোবেসে ফেলেছি কি না সেটা জানি না তবে সেটা যে নিঃসন্দেহে একটি অসম ভালো লাগার গল্প এবং হয় তো বা এক সময় জীবনের শেষ বয়সে এসেও রেনাতোর মতো আমাকে বলতে হবে যে জীবনে অনেক নারীর সংস্পর্শে এসেছি কিন্তু ক্রিস্টিনার মতো কাউকে ভালো লাগে নি কোনও দিনই। সমাজের প্রথাকে ভেঙে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহসও নেই আমার মধ্যে।
জীবনে আসলে যা হারিয়ে যায় তা যেনও সারাজীবনের জন্যই হারিয়ে যায়, শুধু হারিয়ে যাওয়া সে জিনিসগুলো মস্তিষ্কের দৃশ্যপটে থেকে যায় স্মৃতি হিসেবে।
ভালো থেকো ক্রিস্টিনা!!! তোমার সর্বোচ্চ সফলতা কামনা করছি।জানি না আর কোনও দিন্ দেখা হবে কি না তবে সারাজীবন আমি বুখারেস্টের সেই রঙিন মুহূর্তগুলোকে ফিরে পাওয়ার জন্য কেঁদে যাবো, হয় তো বা “শেষের কবিতা” উপন্যাসে উল্লেখিত লাবণ্যের মতো তুমিও আমার কাছে এক দীঘির জল যাঁর প্রতি আমার ভালোলাগা বা ভালোবাসা কোনও দিনও ফুরোবে না।