মাহমুদ মনি »

প্রায় ৪৫ বছর আগের কথা। বেশ লম্বা, কিছুটা কালচে, কিন্তু তেল-চকচকে উদ্দীপ্ত মুখাবয়ব। ছিপছিপে গড়ন আর রসিকতায় ভরপুর তাগড়া এক যুবক। গোলরক্ষক হিসেবে বেশ নামডাক, দেশজোড়া খ্যাতি। নাম ফজলুল করিম। তবে সবাই চেনে ফজলু নামেই।

বলছি, স্বাধীনতার পূর্বাপর দেশসেরা গোলরক্ষক বগুড়ার কৃতীসন্তান জার্মানপ্রবাসী ফজলুল করিমের কথা। তরুণ প্রজন্মের কেউই তাঁকে এখন চেনার কথা না। মনেপ্রাণে চিরতরুণ হলেও দৈহিক বয়সের ভারে কিছুটা ন্যূব্জ ফুটবলার ফজলু। 

১৯৭৭ সালের কথা। কোনো এক গোপন অভিমানে নীরবে-নিভৃতে দেশ ছেড়ে জার্মানি পাড়ি জমান ফজলু। সেই অভিমানের কথা এখনও অজানাই রয়ে গেলো অনেকের কাছে। জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক এই গোলকিপার প্রায় চার দশক ধরে বসবাস করছেন জার্মানিতে।

তরুণ ফুটবলার ফজলুল করিম

জন্ম ও বেড়ে ওঠা

১৯৪৯ সালে জন্ম নেওয়া ফজলুর শৈশব-কৈশোর কেটেছে বগুড়ায়। বাবা জেলা রেজিস্ট্রি অফিসে চাকরি করতেন। আদিবাড়ি জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে হলেও বগুড়ায় থিতু হয়েছিলেন বহু আগেই। বগুড়া শহরে ইন্ডিপেন্ডেন্ট হাসপাতালের সামনে জ্বলেশ্বরীতলায় পৈত্রিক বাড়ি। বগুড়া নিউমার্কেটের তুষান বস্ত্রালয় বিতানের মালিক রেজাউল করিম ফজলুল করিমের বড় ভাই। 

ছাত্রজীবন

ফুটবলার ফজলুর জীবনকর্ম নিয়ে গবেষণা করেছেন সাবেক আরেক ক্রীড়াবিদ ও বগুড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মো. শহীদুল ইসলাম। তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, ফুটবলার ফজলু বগুড়া জেলা স্কুল থেকে তিনি ১৯৬৭ সালে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৬৯ সালে আজিজুল হক কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রান্সফার হয়ে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করেন।

যৌবনে ফজলুল করিম

ফুটবলপ্রেম এবং সহযোদ্ধারা…

জানা গেছে, ফুটবলের সাথে ফজলুর প্রেম সেই স্কুল থেকেই। কিশোরকালেই সবার নজরে পড়েন প্রতিভাবান এই গোলরক্ষক। সেসময় সহপাঠীদের অনুপ্রেরণা আর বগুড়ার কিংবদন্তি ফুটবলার বড় কালু খাঁ, ছোট কালু, আইনুল, সাইফুল, শহজাহান, আবেদুর রহমান নান্টু, আলফাজ আহমেদ গেদা, অমলেশ সেন, আফজাল, চাঁন্দু, লাল, পেস্তা প্রমুখ খেলোয়াড় ছিলেন তাঁর আইকন।

স্কুল পাসের আগেই বগুড়ায় লিগ খেলা শুরু করেন ঐতিহ্যবাহী টাউন ক্লাবের হয়ে। নিপুণ পারফর্মেন্সে খুব সহজেই সবার নজর কেড়ে নেন ফজলু। বিশেষ কৃতিত্বের পুরস্কার স্বরূপ ১৯৬৮ সালে জেলা দলে সুযোগ পান। বগুড়া জেলা দল ১৯৬৯ সালে জাতীয় ফুটবলে ইস্ট পাকিস্তানে চ্যাম্পিয়ন হয়। এই সেই ফজলুল করিম, যিনি ছিলেন সেসময় বগুড়া জেলা দলের একনম্বর গোলকিপার। আর মরহুম আনিছুর রহমান কমিশনার ছিলেন ২নং কিপার। দলের ম্যানেজার ছিলেন উপমহাদেশের কিংবদন্তি ফুটবলার মরহুম মাহবুবর রহমান বড় কালু। বড় কালু সাংবাদিক বেচান-এর বাবা।

ফজলুর জ্বলে ওঠা

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ফজলু তাঁর প্রতিভার প্রায় পুরোটাই মেলে ধরেন। যেন জ্বলজ্বল আগুন হয়ে জ্বলে ওঠেন এই ফুটবলার। সুনাম আর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। নিজের প্রতিভার কারণে নজর কাড়েন তৎকালীন ঢাকা মাঠের ফুটবলের প্রাণপুরুষ বলে পরিচিত বগুড়ার স্বর্গীয় অমলেশ সেনের। তিনিই তাঁকে রাজশাহী থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রান্সফারসহ কম্বাইন্ড ইউনিভার্সিটি টিমে খেলানোর সব বন্দোবস্ত করেন। তাঁরও আগে ফজলুল করিম নিজে এবং অমলেশ, সামাদ,আফজাল জয়পুরহাট সুগারমিলে ফুটবলার হিসাবে চাকরিও করেন। ব্যাস, সেই থেকে শুরু হলো ফজলুর উপরে ওঠা। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি তাঁকে। প্রসঙ্গত, ফজলুল করিম একজন ভালমানের বাস্কেটবল খেলোয়াড় হিসাবেও ঢাকা লিগে ভিক্টোরিয়া এবং ওয়ান্ডার্স ক্লাবে খেলতেন।

ফজলুর ফুটবল সহযোদ্ধারা

যাঁরা ছিলেন সঙ্গী

ক্রীড়াবিদ মো. শহীদুল ইসলাম জানান, দেশে স্বাধীনের আগেই ফুটবলে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছিল। সত্তর দশকের শেষদিকে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে চৌকস কিছু ফুটবলারের আবির্ভাব হয়। নিঃসন্দেহে তাঁরা বিশ্বমানের খেলোয়াড় ছিলেন। জাকারিয়া পিন্টু, সালাউদ্দিন,নান্নু, মন্জু, প্রতাপ সংকর হাজরা, কায়কোবাদ, শামছু, কাজী সাত্তার, কাজী আনোয়ার, আশরাফ, আব্দুর রহীম, শহীদুর রহমান সান্টু , জাসদ নেতা সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হন ইনু, নিজাম, মোত্তালিব, আবদুল গফুর, চুন্নু, অমলেশ সেন, আফজাল, রামা লুশাই, বাটু, নওশের, হাফিজ উদ্দিন, এনায়েত, আশিষ ভদ্র, জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাসহ আরও অনেকেই তখন চোখ ধাঁধানো ফুটবল খেলতেন। আমাদের বগুড়ার ফজলুল করিমও সেই সকল তারকাদের কাতারভুক্ত হন ‘৬৯ সালে, সেই অমলেশ সেনের হাত ধরেই। এবং সেই একঝাঁক সোনালী নক্ষত্র স্বাধীনতার পরেও তাঁদের আলোর ঝলকানি অব্যাহত রেখেছিল। যা আজ নিভে গিয়ে ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার!

যেসব ক্লাবে খেলেছেন

জানা গেছে, ১৯৬৯ সালে ফজলু প্রথমে ইস্ট-অ্যান্ড ক্লাবে খেলেন। তখন অমলেশ সেন, আফজাল এবং বর্তমান জাসদ নেতা সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ছিলেন ওই ক্লাবের গোলকিপার। পরে জনাব ইনু মোহামেডান ক্লাবে চলে যান। এবং ফজলুল করিমও পর্যায়ক্রমে ভিক্টোরিয়া, পিডাব্লিউডি, ওয়াপদা, রহমতগঞ্জে খেলে শেষে আবাহনী ক্লাবে যোগ দেন। তখন আবাহনীর কিপার ছিলেন নিজাম, সাথে ছিলেন বগুড়ার অমলেশ সেন এবং আফজাল হোসেন। তারও আগে তিনি তিনবার জাতীয় দলে সুযোগ পান। তখন রংপুরের শহীদুর রহমান শান্টু ছিলেন একনম্বর কিপার। ১৯৭৪ সালে মস্কোর সাথে খেলে তিনি ভূয়সী প্রসংশা পান। সবাই তখন যেন তাঁর প্রসংশায় পঞ্চমুখ। এর পর মোহমেডানের সাথে খেলার সময় গুরুতর আঘাতে তাঁর চোয়াল ভেঙে যায়।

মুক্তিযোদ্ধা ফজলু

ফজলুল করিম কেবল একজন ফুটবলারই নন, একজন মুক্তিযোদ্ধাও। স্বাধীনবাংলা ফুটবল টিমে সুযোগ পেয়েও তিনি ইনু সাহেবের সঙ্গে ভারতের দেরাদুন ক্যাম্প থেকে ট্রেনিং নিয়ে দেশে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। সাথে ছিলেন শহীদ চাঁন্দু এবং জাসদের বগুড়ার নেতা রতনসহ অনেকে। যুদ্ধশেষে স্বাধীন বাংলাদেশের গর্বিত অংশীদার ফজলু ঢাকা স্টেডিয়ামে অস্ত্র জমা দিয়ে আবার ফিরে যান ছাত্রজীবনে। একই সঙ্গে তাল মিলিয়ে দাঁপিয়ে বেড়াতে থাকেন খেলার মাঠও।

পুরো পরিবারের সঙ্গে ফজলুল করিম

অজানা অভিমান…

আবাহনী ক্লাবে থাকাকালীন ফজলুল করিম চিটাগাং লিগেও খেলতেন। ১৯৭৭ সালে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এমনকি ক্লাব, কাউকেই কিছু না জানিয়ে চিটাগাং খেলতে যাওয়ার কথা বলে এককাপড়ে খেলার ব্যাগ ঘাড়ে নিয়ে পশ্চিম জার্মানিতে পাড়ি জমান। অভিমান নিয়ে এমন অভিবাসী হওয়ার কারণ আজও অজানাই রয়ে গেছে সবার কাছে।

প্রবাসী ফজলু

মাঝেমাঝে বগুড়া গেলেও তিনি স্থায়ীভাবে জার্মানিতেই বসবাস করেন। তাঁর স্ত্রী ইরিশ একজন জার্মান। তিন কন্যা ইয়াসমিন, সাবিনা আর নাদিনসহ মেয়েদের জামাই, দুই নাতনি তাঁর সারাক্ষণের সঙ্গী। সব মিলিয়ে বেশ ভালোই আছেন ফজলুল করিম। তিন মেয়ের সবাই-ই বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে এখন চাকরিবাকরি করছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। কিছুদিন আগে বেশ ঘটা করে আয়োজন করা হলো তাঁর ৭০তম জন্মদিন।

শেয়ার করুন »

মন্তব্য করুন »